আমার দেখা এরশাদ- ১
- প্রকাশের সময় : ০৮:৫২:৪৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০১৯
- / ৩৮৮ বার পঠিত
সাঈদ তারেক
চলে গেলেন এরশাদ।
গত ১৮ জানুয়ারী যখন তাকে সিএমএইচে দেখতে যাই তার কয়েকদিন আগে থেকেই প্রচারনা চলছিল অবস্থা সঙ্গীন। সাক্ষাৎশেষে ফিরে এসে লিখেছিলাম যতটা বলা হচ্ছে ততটা গুরুতর নয়। তবে বয়সের ভারে ন্যুব্জ নানা অসুুখে কাতর এরশাদ এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। শেষ পর্যন্ত যমে ডাক্তারে টানাটানি সাঙ্গ হলো। বাংলাদেশের রাজনীতির এক বহুল আলোচিত পুরুষ- এরশাদ সাহেব পাড়ি জমালেন অনন্তের পথে।
কয়েকদিন ধরে তাকে নিয়ে নানাজনের নানা মত পড়ছি ফেসবুকের পাতায়। ওপেন প্লাটফর্ম, যে কেউ যা কিছু লিখতেই পারেন। পাঠক তা পড়তে বাধ্য নয়। তবে আমি চেষ্টা করেছি প্রায়গুলো পড়তে। যেটা মনে হয়েছে- লিখিয়েদের একটা বড় অংশ এরশাদ সম্পর্কে জানেন না, যতটুকু জানা বাপ-মা’র কাছ থেকে শুনে। যাদের বয়স এরশাদকে জানার এবং এরশাদকাল দেখার, তারা কম লিখেছেন। একটি ক্ষুদ্র অংশ যারা এরশাদের শাষনকালে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ তারা ধুয়ে দিয়েছেন। এসব লেখা কমেন্ট মন্তব্যের ব্যপারে কিছু বলার ইচ্ছা বা অভিরুচী আমার নাই। ভদ্রলোকের সাথে কিছুকাল কাজ করার সুযোগ হয়েছিল, তাকে কাছে থেকে দেখেছি, সে সুবাদে কিছু তথ্য, ঘটনা এবং ব্যাখ্যা আমার জানা। মনে হলো সেগুলো শেয়ার করা যায়।
সব বলতে গেলে বা বিস্তারিত বলতে গেলে একটা ঢাউশ পুস্তক হয়ে যাবে। এটা পড়ার ধৈর্য্য অনেকের থাকবে না। তবে যে দুইএকটি বিষয় না বললেই নয়- চেষ্টা করছি উল্লেখ করতে। আমার এ লেখা এরশাদ সাহেবকে ডিফেন্ড বা ডিফেইম করার জন্য নয়, তার মুল্যায়নের দায় অনাগত ইতিহাসের।
দুই দফা তার হয়ে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। এক: ’৮৩-’৮৪ সালে মার্শাল ল’ ওঠানোর ক্ষেত্র তৈরীর লক্ষ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের দায়িত্ব পালন করার সময়। দুই: ’৯১-’৯৬ এরশাদ সাহেব যখন জেলে। ‘মার্শাল ল’ ওঠানোর ক্ষেত্র তৈরীর লক্ষ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন’ কথাটা অদ্ভুত মনে হবে। হ্যাঁ, এই ইতিহাসটাই কেউ জানেন না। যে দুইএকজন জানতেন তারা কেউ বলেন নাই। ’৮২-এর ২৪ মার্চ এরশাদ সাহেব যখন সাত্তার সরকার থেকে ক্ষমতা নিয়ে মার্শাল ল’ জারী করেন আমি তখন পুরোদস্তুর সাংবাদিক। একজন লড়াকু ইউনিয়ন নেতা। এই মার্শাল ল’ জারীর ব্যাপারটা কয়েক মাস আগে থেকেই বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছিল। সে সময় তৎকালীন সংসদের শেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল শেরে বাংলা নগরের বর্তমান সংসদ ভবনে। ওই ভবনের নির্মান কাজও তখন শেষ হয়নি। তার মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে সেখানে অধিবেশন আহ্বান করা হয়। মনে আছে প্রথম দিনের অধিবেশনের এক বিরতিতে ক্যান্টিনে চা খাচ্ছিলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক এবং বিরোধী দলের সদস্য। কে কে ছিলেন অতটা মনে নাই। আমাদের মাঝ থেকে কেউ প্রশ্ন করলেন, তাড়াহুড়ো করে এই অসমাপ্ত ভবনে কেন অধিবেশন ডাকা হলো। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী সেখানে ছিলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, আলামত বুঝতেছেন না! এইটারে যেন মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার বানাইতে না পারে তাই দখল নিয়া রাখলাম।
হ্যাঁ আলামত তখন সুবিধার ছিলনা। পরিস্থিতি দ্রুত বদলে চলছিল। সাত্তার সরকার সামাল দিতে পারছিল না। দেশে অরাজকতা চরমে। মন্ত্রীর বাড়ী থেকে খুনের আসামী গ্রেপ্তার বেআইনী অস্ত্রসহ মন্ত্রী আটক- এ জাতীয় খবরগুলো বেশ প্রচার পাচ্ছিল। একই সাথে সেনাপ্রধান এরশাদের কিছু কথাবার্তা ইঙ্গিত দিচ্ছিল ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে। এমনি একটা পরিস্থিতিতে দেশে মার্শাল ল’ জারী হয়। আমাদের কাছে মনে হলোনা যে বন্দুক ঠেকিয়ে সাত্তার সাহেবের কাছ থেকে জোর করে ক্ষমতা নিয়ে নেয়া হয়েছে। যেন তিনি রেডিই ছিলেন। পরদিন এই মার্শাল ল’কে নানাভাবে স্বাগত: জানানো হয়। সম্ভবত: বাংলার বাণী পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল- ‘এক ফোটা রক্ত ঝরেনি একটা গুলী ফোটেনি’ বা এই জাতীয় কোন শিরোনাম দিয়ে। নতুন শাষকরা তাদের শাষনক্ষমতাকে নাম দিলেন ‘জনগনের মার্শাল ল’। এই মার্শাল ল’ যেন বিরোধী দলগুলোকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিল।
এর অনেক পরে, সম্ভবত ’৮৩এর শেষের দিকে ঘটনাচক্রে আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তরে ‘মাস কন্টাক্ট সেলে’র সাথে সম্পৃক্ত হই। এই সেলের প্রধান ছিলেন বিগ্রেডিয়ার নাজিরুল আজিজ চিশতি। সচিব- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুল, ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কালাম মাহমুদ এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাজুল ইসলাম। এর সমন্বয়ক বা কোঅর্ডিনেটর ছিলেন লে: কর্ণেল মুনিরুল ইসলাম (মুন্না)। অল্প কিছুদিনের জন্য কাজ করতে এসেছিলেন সাংবাদিক শামসুদ্দিন আহমেদ (পেয়ারা)। এই সেলের কাজ ছিল মুলত: বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নিউজ কাটিং তৈরী করা, তার ওপর প্রতিবেদন লেখা। মুল্যায়ন। কিছু কিছু সুপারিশ। দেড় বছরের ওপরে হয়ে গেছে, মিডিয়ায় সেন্সরশীপ চলছে। রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ। সরকারের কিছুকিছু সিদ্ধান্তে জনঅসন্তোষ, এ সবের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল। সামরিক বিধি ভঙ্গ করে ছোটখাট সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। প্রশ্ন ওঠে এভাবে কতদিন। নির্বাচন কবে হবে। আমরা এসব নিয়ে পর্যালোচনা করতাম এবং মতামত তৈরী করতাম।
আমার কাছে মনে হয়েছিলো নির্বাচন বা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে এদের কোন চিন্তাভাবনাই যেন নাই। অথচ এভাবে তো চিরদিন চলবে না। মাঝেমাঝে কর্ণেল মুন্নার সাথে এ নিয়ে কথা বলতাম। সে বলতো আরে এত তাড়াতাড়ির কি আছে। ওরা আসলে তো আবার আগের মত হয়ে যাবে। আমরা কিছু কাজে হাত দিয়েছি শেষ করে নেই। একদিন ব্রিগেডিয়ার চিশতির সাথে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলি। আমার যুক্তি ছিল- দীর্ঘদিন মার্শাল ল’ থাকলে মানুষ আর্মির ওপর বিরক্ত হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলো আর অপেক্ষা করতে রাজী নয়। তারা দ্রুত নির্বাচন চাইছে। নইলে আন্দোলন শুরু করে দেবে। ব্রিগেডিয়ার চিশতি সেদিন উত্তরে যা বলেছিলেন তার সার কথা ছিল, নির্বাচনের পর মাশার্ল ল’ রেটিফিকেশনের দায়িত্ব কে নেবে। তাদের সকল কর্মকান্ড যদি সংসদে সংবিধানসিদ্ধ না করা হয় তাহলে সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কে চাইবে ফাঁসির দড়ি গলায় নিতে! রাজনৈতিক দলগুলোকে তো কথা দিতে হবে যে সংবিধান সংশোধন করে তারা আমাদেরকে দায়মুক্তি দেবে। এর আগে মার্শাল ল’ ওঠে কিভাবে! অবশ্য এটা ঠিক, রেটিফিকেশন বা সংবিধান সংশোধন করে এক্সট্রাকন্সটিটিউশনাল বা সংবিধান বহির্ভুত শাষনকালকে দায়মুক্তি দেয়া আমাদের দেশে একটি প্রচলিত রীতি। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান দিয়ে গেছেন। ’৯১এ আওয়ামী লীগ বিএনপি মিলে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের অবৈধ শাষনকালকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছেন। ২০০৮এ একইভাবে মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের কর্মকান্ডকেও বৈধতা দেয়া হয়েছে।
সেদিন আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় নির্বাচন নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কথা বলবো। তবে প্রকাশ্যে নয়, ঘরোয়াভাবে। চিশতি সাহেব এই আলোচনাবৈঠক আয়োজনের দায়িত্ব আমাকে দিলেন। পরদিন থেকে শুরু হয়ে যায় আমার নতুন মিশন।
সাংবাদিকতার সুবাদে অনেক রাজনৈতিক নেতার সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে সংসদ অধিবেশন কাভার করতাম বলে সংসদকেন্দ্রিক নেতাদের সাথেই যোগাযোগ ছিল বেশী। সে আমলে সংসদ ছিল আসলে বিরোধীদলের জন্য। সেখানে সরকারি দলের সদস্যদের চাইতে বিরোধীদের গুরুত্ব থাকতো বেশী। আমরাও বিরোধীদের বক্তৃতা বিবৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে রিপোর্ট করতাম। ফলে বিরোধী সদস্যরাও সাংবাদিকদের সাথেই সখ্যতা গড়ে তুলতেন। ’৭৯-এর সংসদে জিয়াউর রহমান অধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে এমপি করে এনেছিলেন। সম্ভবত: এত বেশী দলের প্রতিনিধিত্ব এই সংসদেই ছিল। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ (হাসিনা এবং মিজান- উভয় গ্রুপ), জাসদ ছাড়াও মুসলিম লীগ কেএসপি একতা পার্টি মোজাফ্ফর ন্যাপ ওয়ার্কার্স পার্টি (বা ইউপিপি) এমনকি গুপ্ত সংগঠন (ততদিনে প্রকাশ্য হয়ে গেছে) সাম্যবাদী দলের প্রতিনিধিত্বও ছিল এ সংসদে। সিপিবি ভাসানী ন্যাপের কেউ ছিলেন কিনা মনে করতে পারছি না। যাহোক, এসব দলের প্রায় সকল এমপি’র সাথেই আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। অধিবেশনের বিরতিতে আমরা আড্ডা মারতাম, কারও সাথে বাইরেও দেখা সাক্ষাৎ হতো। ছিলেন শাহজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন, এ এস এম সোলায়মান, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আ স ম ফিরোজ, সুধাংশুশেখর হালদার। এছাড়াও আওয়ামী লীগের কয়েকজন এমপি’কে কোনদিন ভুলবো না। অতিশয় সজ্জন নিখাদ ভদ্রলোক মাগুড়ার আসাদুজ্জামান, নওগার ইমাজউদ্দিন প্রামানিক এবং নোয়াখালীর এবিএম তালেব আলীর সাথে পরিচয় ছিল ’৭৩-এর সংসদ থেকেই। ’৭৯-এর সংসদে তা গাঢ় হয়। এরা ছিলেন আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ এবং একনিষ্ঠ সেবক। সব চাইতে ভাল সম্পর্ক ছিল সুরঞ্জিত দা’র সাথে। তিনিও কেন যেন আমাকে ছোট ভাইয়ের মতই ¯েœহ করতেন। বৌদি ভাল রান্না করতেন। মাঝেমাঝেই বন্ধু মতিউর রহমান চৌধুরী (বর্তমানে দৈনিক মানবজমিনের সম্পাদক) আর আমি প্রেসক্লাব থেকে রিকশায় চেপে এলিফেন্ট রোড উড়োজাহাজ মসজিদের উল্টোদিকে দাদার বাসায় চলে যেতাম। বৌদি সব সময় হাসিমুখে আপ্যায়ন করতেন। আমরা পেটপুরে খেয়ে সারা বিকাল আড্ডা মারতাম।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার জন্য নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের একটি কক্ষ ঠিক করা হয়। আমি আগেই বিভিন্ন দলের নেতার সাথে কথা বলতাম। তাদের কাছ থেকে সময় নিয়ে এসে ব্রিগেডিয়ার চিশতিকে জানাতাম। বৈঠকগুলো হতো সন্ধ্যার পর। নেতারা আর্মি অফিসারের সাথে মিটিংয়ে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। ফলে তারা চাইতেন না এসব বৈঠকের খবর কেউ জানুক। বৈঠকে চিশতি সাহেবের সাথে একমাত্র আমি উপস্থিত থাকতাম। কোন কোন বৈঠক আমাকে ছাড়া একান্তেও হতো। সুরঞ্জিত দা এলেন। মেনন ভাই নিজে না এসে হায়দার আকবর খান রনো ভাইকে পাঠান। বিএনপি তখন বিরোধী দলে। তাদের সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেয়ায় তারা তখন সেনাশাষনের ওপর মহা খ্যাপ্পা। ওদেরকে বৈঠকে ডাকা নিরর্থক বিবেচনায় সে দলের কারও সাথে যোগাযোগ করা হয় নাই। এএসএম সোলায়মান, শাজাহান সিরাজসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতার সাথে বৈঠক হয়। প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমেদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেন নাই। যা বলার আমাকে বলে দিয়েছিলেন। এসব বৈঠকে নেতারা দাবী করেন- অবিলম্বে মার্শাল ল’ তুলে নতুন নির্বাচন দিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে সকল বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে। ব্রিগেডিয়ার চিশতি রেটিফিকেশনের নিশ্চয়তা চান। নেতাদের কেউ বলেন, সে দায় আমরা নেব কেন। কারও কথা, যেভাবে এসেছেন সেভাবেই যাবেন। কেউ বললেন আমরা রাজনীতি করি, আমরা সব সময় আর্মি রুলের বিরুদ্ধে। আমরা কি করে সেনা শাষনের বৈধতা দিতে পারি। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বলেন, যেভাবেই হোক আমরা এসে গেছি, তবে চিরদিন থাকার জন্য নয়। নির্বাচন দেব। আপনারাই দেশ চালাবেন। কিন্তু আমাদের যাবার পথটা তো করে দিতে হবে। নেতাদের এক কথা- মার্শাল ল’ তুলে নির্বাচন দিন। কিন্তু এভাবে মার্শাল ল’ তুলে নেয়া যায় কিনা বা মার্শাল ল’ তুলে নিলে সরকার চালাবে কে, এ প্রশ্নের উত্তর সবাই এড়িয়ে যান।
বেশ কয়েকদিনব্যাপী আলোচনার সার দাঁড়ালো- রাজনৈতিক দলগুলো রেটিফিকেশনের দায়িত্ব নিতে রাজী নয়। চিশতি সাহেব একদিন বললেন, দেখলা তো, আগেই বলছিলাম এদের সাথে কথা বইলা লাভ নাই। সেটা ঠিক আছে, কিন্তু আমি ভাবছিলাম তাহলে মার্শাল ল’ তোলার উপায়টা কি! মাসকন্টাক্ট সেলে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক আমার কর্ণেল মনির বা মুন্নার সাথে। মুন্না আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচমেট। ও পড়তো সোসিওলজিতে, শেখ কামালের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মুন্নার সাথে আমার পরিচয় ছিল না, চেনাজানা হয় এখানে এসে। প্রচুর মেধাবী এবং একজন চৌকষ আর্মি অফিসার। বিস্তর লেখাপড়া। মার্কসবাদ, ডাস ক্যাপিটাল কমিউনিজম সোসিওলিজম পুজিবাদ বিশ্ব ইতিহাস রাস্ট্রবিজ্ঞান সমাজনীতি- হেন কোন বিষয় নাই যা সম্পর্কে মুন্না অনর্গল বলতে পারতো না। ওর জ্ঞানের পরিধি দেখে মাঝেমাঝে আমি অবাক হয়ে যেতাম। একদিন মুন্না বলেছিল, আপনারা তো মনে করেন আর্মি অফিসারদের বুদ্ধি হাটুতে, আমরা যতটুকু স্টাডি করি আপনাদের কলেজ ইউনিভার্সিটিতে তার তিলমাত্রও হয় না। কথাটা আমি ফেলতে পারি নাই। সে সময় সিএমএলও সচিবালয়ে অনেক আর্মি অফিসারের সাথে আমার আলাপ পরিচয় হয়েছে। বিভিন্ন র্যাংকের অফিসারদের সাথে উঠবোস করেছি, তাদের সান্নিধ্যে এসেছি। মনে হয়েছে একএকটা ব্রিলিয়ান্ট। সত্যি বলতে কি সে সময় থেকে আমাদের আর্মি অফিসারদের সম্পর্কে আমার ধারনাই পাল্টে যায়।
মুন্না ছিল পুরোপুরি প্রফেশনাল। ব্রিলিয়ান্ট অফিসার বলে তাকে দিয়ে গনপ্রশাষন বা ‘জনগনের শাষন’ বিষয়ে আমলাদের ক্লাশ নেওয়ানো হতো। মুন্না গিয়ে ডিসি এসপিদেরকে বোঝাতেন কি করে প্রশাষনকে গনমুখী করা যায়। আমি সকল বিষয় মুন্নার সাথে শেয়ার করতাম। নেতাদের সাথে বৈঠকের ফলাফল নিয়ে একদিন দু’জন আলোচনায় বসি। আমি বলি, এখন তো দেখছি নিজেদের রেটিফিকেশন নিজেদেরই নিতে হবে। মুন্না গভীর দৃস্টিতে তাকিয়ে থেকে বলেন, কি করবেন? বিএনপি’র মত আর একটা সিএনপি বানাবেন? কি লাভ! সেই তো একই অবস্থা হবে। তাহলে আমরা গাধার মত এত খাটছি কেন? আমাদেরকে কাজ করতে দেন। ওসব পলিটিক্সফিক্স পড়ে দেখা যাবে। আমি বলি কিন্তু দলগুলো তো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। মুন্নার সাফ জবাব- তাহলে সরকার আছে কি করতে! ইঙ্গিতটা পরিষ্কার।
সে সময় আমার যেটা মনে হচ্ছিল- সরকারি উদ্যোগে কোন রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যপারে এরা তখনও একমত নয়। এরশাদ সাহেব সেনাপ্রধান, সরকার প্রধান। রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানীদের পক্ষ থেকে তার ওপর একটা চাপ ছিল। সামরিক সরকারে একমাত্র সিভিলিয়ান মন্ত্রী বা উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ছিলেন এলজিআরডি’র দায়িত্বে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি সারা দেশে ১৮ দফা বাস্তবায়ন পরিষদ নামে একটি বেসরকারি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। ১৮ দফা ছিল এরশাদ ঘোষিত কর্মসুচী। এই সংগঠনের মাধ্যমে মাহবুবুর রহমান সাহেব ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন এটিই এরশাদ সাহেবের ভবিষ্যত রাজনৈতিক দল। নানা ধরনের লোক এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিল। ওদিকে এরশাদ সাহেব ক্ষমতা নেয়ার কিছুদিনের মধ্যে বিএনপি’র একটি ধান্ধাবাজ গ্রুপ দল ভেঙ্গে ‘হুদা-মতিন বিএনপি’ নামে একটি আলাদা সাইনবোর্ড খুলে বসেছিল। বিএনপি’র অনেক সাবেক এমপি এই দলে যুক্ত হয়েছিল। তাদেরকে ধারনা দেয়া হয়েছিল এটিই হবে এরশাদ সাহেবের নতুন রাজনৈতিক দল। পাশাপাশি ডিজি ডিএফআই ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুল হাসান এটিএম রফিককে দিয়ে নতুন বাংলা যুব সংহতি নামে একটি যুব সংগঠন দাড় করিয়ে তার পৃষ্ঠপোষকতা করে চলছিলেন। এরাও ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন, এরশাদ সাহেব রাজনৈতিক দল গঠন করলে তারাই হবে তার মুল শক্তি।
কিন্তু সিএমএল সচিবালয়ে এসব নিয়ে কোন আলোচনা বা আগ্রহ ছিল না। মুন্না একদিন বলছিলেন, আমরা কোন দলফল গঠনের চিন্তা করছি না। দ্যাখেন না মাহবুবুর রহমান কি দৌড়ঝাপ করছেন! কোন লাভ নাই। যেসব লোক তিনি জড়ো করেছেন তাদেরকে দিযে যদি আমাদেরকে দল করতে হয় তাহলে বিএনপি কি দোষ করেছিল!
’৮৪-এর অগাস্ট সেপ্টেম্বর সময়কালটা সরকারের জন্য নিরুপদ্রুত ছিলনা। প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেছে, সরকার নির্বাচন দেয়ার নাম মুখে আনছে না। রাজনীতি ঘরোয়া কর্মকান্ডের মধ্যে সীমিত। দলগুলো ইনডোর বৈঠক আলোচনা সভা শোকসভা মিলাদ মাহফিল বা কুলখানির মত অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেতো। মাঠে ময়দানে মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে এসব নিষেধাজ্ঞা অমান্য হচ্ছিল। মাঝেমাঝে সরকারি বাহিনীগুলোর সাথে ছাত্রদের সংঘাত সংঘর্ষ হচ্ছিলো। এসব ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটতো। সবকিছু মিলিয়ে দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবীতে সরব হয়ে চলছিল। রাস্তায় নেমে আসছিল। আমরা গনসংযোগ সেলে এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতাম। এম আর আখতার মুকুল ভাই ছিলেন আমাদের সিভিলিয়ান বস। দিলখোলা হা হা হাসির মানুষ। এক সিগারেটের আগুন দিয়ে আর একটা ধরাতেন। যাকে বলে কন্সট্যান্ট স্মোকার। পোল্ডফ্লেকে কড়া টান দিয়ে প্রায়ই বলতেন, এইভাবে তো চলবে না! পলিটিকাল পার্টিগুলা খেপে গেলে খবর আছে। আমরা সেলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন এবং সুপারিশ দাখিল করে চলি। কিন্তু ওপর মহলে তার কোন প্রতিক্রিয়া পাইনা। এভাবেই চলছিল দিন। আমি মাঝেমাঝে এ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার চিশতি এবং কর্ণেল মুন্নার সাথে আলাপ করতাম। দলগুলোর সাথে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় চিশতি সাহেব রাজনীতির বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। মুন্না ব্যস্ত ছিলেন সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বিভিন্ন কর্মশালা এবং ট্রেনিং নিয়ে।
’৮২-তে মার্শাল ল’ জারির পর থেকেই সামরিক সরকার বেশ কিছু জনকল্যানধর্মী কর্মসুচী হাতে নিয়ে চলছিল। বৃটিশ প্রবর্তিত শতাব্দীপ্রাচীন প্রশাষনিক কাঠামো- যা কিনা আজ পর্যন্ত ভারত বা পাকিস্তান পরিবর্তন করতে পারে নাই, আর্মি সরকার অধ্যাদেশ জারী করে তা বদলে যুগোপযোগী করে। থানাগুলোকে উন্নীত করে স্বায়ত্বশাষিত প্রশাসনিক সংস্থায় পরিনত করা হয়। পরে এর নামকরন করা হয় উপজেলা। এই উপজেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে ভৌত অবকাঠামোর ব্যপক উন্নয়ন হয়। উপজেলা কানেক্টিং রোড, নতুন নতুন দালানকোঠা নির্মান, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সুবিধা সম্প্রসারন- এসব কর্মকান্ড গ্রামীন জনজীবনে ব্যপক পরিবর্তন আনতে থাকে। স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে দেশীয় শিল্পোদ্যগকে উৎসাহিত করা হয়। মনে আছে দেশীয় শিল্প কারখানার প্রটেকশনে প্রাথমিকভাবে ১১৪টি পণ্যের আমদানী নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাস্থ্যনীতির আওতায় অপ্রয়োজনীয় অনেক অষুধ ব্যান্ড করা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকেও যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সম্ভবত: ছাত্রদের আন্দোলনের কারনে সে উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অবশ্য সামরিক সরকারের এসব কর্মকান্ডের কোনটাই প্রশংসিত হয় নাই। তারা স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়া এবং মার্শাল ল’ তুলে নিয়ে নির্বাচনের এক দফা দাবীতে একট্টা হচ্ছিলো। পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না।
এ সময় আমার মাথায় একটা ছেলেমানুষি খেয়াল চাপে। সিরাজুল আলম খানের ভাবশিষ্য, একসময় সর্বহারা বিপ্লব বা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতাম। দাদা তো জিয়াউর রহমানকে দিয়ে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন, আমরাও কি এদেরকে দিয়ে কিছুটা কাজ করিয়ে নিতে পারিনা! এরা যে কাজগুলো করছে তা তো সংষ্কারধর্মী। সাধারন মানুষ সমর্থন করছে। তার অর্থ মানুষের জন্য ভাল কিছু করার ইচ্ছা এদের আছে। সামরিক সরকার বলে চিরদিন এরা থাকবে না। এই জনকল্যানমুখী কাজগুলোকে অব্যাহত রেখে এর ধারাবাহিকতায় সমাজ পরিবর্তনে আরও কিছু কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরের সিভিলিয়ান সরকারটা কেন আমাদের হতে পারে না! কয়েকদিন বিষয়টা নিয়ে একাএকাই ভাবি। কারও সাথে শেয়ার করা উচিত, কিন্তু কার সাথে! মুন্না। ঠিক করি মুন্নার সাথেই এ নিয়ে কথা বলতে হবে।
পরের কয়েকদিন মুন্নার সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে থাকি। অফিসারটি ছিল খানিকটা অস্তির টাইপের। কথা বলতো উচ্চস্বরে। ততদিনে বুঝে নিয়েছিলাম এর সাথে কথা বলতে মেজাজমর্জি বুঝে নেয়া উচিত। অফিসে নানা কাজে ব্যস্ত, গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে আলোচনার পরিবেশ নাই। ঠিক করি বাসায় গিয়ে কথাটা তুলবো। এ্যপয়েন্টমেন্ট করে এক বিকেলে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় যাই। কর্ণেল মুনির বিয়ে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বড় মেয়ে সিমিকে। সম্ভবত: প্রেমের বিয়ে। আমি যখন দেখেছি তখন পর্যন্ত উভয়ের বোঝাপড়া চমৎকার। ভাল সম্পর্ক। পরে এই সম্পর্ক টেকে নাই। বিচ্ছেদ হয়ে গেছিল। সেদিন বিকেলে ভাবী আমাকে চা নাশতা দিয়ে আপ্যায়ন করেন। চা খেতে খেতে দেখি মুন্না সাদা হাফপ্যান্ট সাদা গেঞ্জি পড়ে র্যাকেট হাতে রেডি। আমি অবাক হয়ে শুধাই কোথায় চললেন? বলে, চলেন একটু স্কোয়াশ কোর্টে যাই। অনেকদিন যাওয়া হয়না। আজ একটু পিটিয়ে আসি। অগত্যা আমি তার সঙ্গী হই। সম্ভবত: স্কোয়াশ ছিল মুন্নার প্রিয় খেলা। সেদিন পুরো বিকেল মুন্না র্যাকেট দিয়ে বল পিটিয়ে চলেন। আমি অদুরে বসে মাঝেমাঝে সৌজন্যতামুলক হাততালি দেই। ঘন্টাদুয়েক বল পিটিয়ে যখন থামেন তখন রীতিমত হাফাচ্ছেন। গেঞ্জি-প্যান্ট ঘামে চুপচুপে। ওর ওই অবস্থা দেখে আমার আলোচনা করার ইচ্ছা লোপ পায়। ফিরে আসি বাসায়। মুন্না বাথরুমে ঢোকার আগে আমাকে বসতে বলেন। আমি ভেবে দেখি এই বসা হবে অর্থহীন। আজ আর কোন সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারেনা। বলি, আর বসবো না। কাজ আছে চলে যাই। মুন্না বলেন কি যেন বলবেন বলেছিলেন। বলি, অন্য কোন সময়। আপনি পরিশ্রান্ত রেস্ট নেন।
এভাবে আরও দুইএকদিন চলে যায়। কথা বলার সুযোগই পাইনা। আমি যে ওর সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় আলোচনা করতে চাই সেটা সে বেমাুলম ভুলে গেছে। এর মধ্যে কুমিল্লার কোটবাড়ী বার্ডে একটা কর্মশালায় ক্লাশ নেয়ার জন্য মুন্নার ডাক পড়ে। ঠিক করি আমি সাথে যাবো। লম্বা রাস্তা, গাড়ীতে কথা বলা যাবে। মুন্নাকে বললে সে রাজী হয়। সে আমলে ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তা প্রায় ফাঁকা। তবে সড়– এবং মাঝেমাঝে ভাঙ্গা এবড়োথেবড়ো। ঘন্টা দু’য়েকে চলে আসি বার্ডে। কিন্তু গাড়ীতে কথা তোলার ফুরসুত পাইনা। বার্ডে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক মুন্নার বক্তৃতা শুনি। বাঘা বাঘা সব সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারি। সারবেধে বসে আছেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুন্না ইংরেজী বাংলায় বক্তৃতা করে চলেছেন। উপস্থিত সবাই যেন অনুগত ছাত্রের মত গোগ্রাসে তাই গিলছেন। মুন্না ঝানু মাস্টারের মত মাঝেমাঝে ব্লাকবোর্ডে চক ডাস্টারও এস্তেমাল করছেন। এই দীর্ঘ ক্লাশ শেষে চা নাশতা খেয়ে আমরা ফিরতি পাড়ীতে উঠি। ফেরার পথে এডামেন্ট হই কথাটা তুলবোই।
প্রথমেই বক্তৃতা কেমন হলো। মুন্না সব সময়ই ভাল ক্লাশ নিতো। বক্তৃতায় প্রচুর রেফারেন্স কোটেশন থাকতো, আবেগ থাকতো এ্যাপীল থাকতো। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। আমিও ছিলাম তার বক্তৃতার একজন গুনমুগ্ধ শ্রোতা। ভাল বক্তৃতা করায় সেদিন মুন্নার মন-মেজাজ ছিল ফুরফুরে। আমি সড়াসড়িই কথাটা তুলি। শুরুতে দেশের পরিস্থিতি, এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা ও অবস্থান, পরিশেষে আমাদের কি করনীয়। মুন্না আমার কাছেই জানতে চান কি করা যেতে পারে। আমি ততদিনে এদের পাল্স কিছুটা ধরে ফেলেছি। আমার মত করে নানা ব্যাখ্যা দিয়ে বলি, মার্শাল ল’ চিরদিন থাকবে না। কিন্তু যে সংষ্কার কাজগুলো আপনারা করছেন তা জনকল্যানধর্মী। কোন রাজনৈতিক দল করলে তা হতো সামাজিক বিপ্লব। এমন বিপ্লবই আমাদের দরকার। কেন, নয় এই বিপ্লব আমরা ধরে রাখি!
মুন্না ইঙ্গিতটা বোঝেন। শুধান কাকে দিয়ে ধরে রাখবেন। মানুষ কই? সৎ আদর্শবান দুর্নীতিমুক্ত ত্যাগী নেতা কর্মী লাগবে। টাউট বাটপারদের দিয়ে আপনি বিপ্লব করবেন? আমরা পার্টি করার উদ্যোগ নিলেই দুনিয়ার যত বাজে মাল জুটে যাবে! আমি বলি, সারা দেশে এখনও ভাল মানুষ আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন স্বপ্নপুরন না হওয়ায় হতাশ হয়ে বসে আছেন। আমরা এদেরকে খুজে বের করবো। নতুন নেতা কর্মী তৈরী করবো। এসব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। এক পর্যায়ে মুন্নাকে বেশ সিরিয়াসই মনে হয়। ইতিমধ্যে আমরা দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছাকাছি এসে যাই। তখনও মেঘনায় সেতু হয় নাই। দুই দফা ফেরিতে গাড়ী পার করতে হতো। ঘাটে পৌছার আগেই গাড়ীর একটা চাকা পাংচার হয়ে যায়। ড্রাইভার সেটা ঠিক করাতে নিয়ে গেলে আমরা গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়াই। পাশের টংঘর থেকে চা নিয়ে খেতে খেতে আমাদের কথা চলে। চা পান শেষে দু’জন সিগারেট ধরাই। মুন্না সিগারেট খেতেননা, তবে টেনশনে থাকলে মাঝেমাঝে দুইএক টান দিতেন। শেষ পর্যন্ত এসে মুন্না আমার সাথে একমত হন। আমরা একটি দল গঠন করবো। টাউট বাটপারমুক্ত ত্যাগী সৎ আদর্শবান নেতা কর্মীদেরকে নিয়ে একটি সত্যিকার জাতীয়তাবাদী দল। ‘ফাইনাল’ বলে দু’জন হাত মেলাই। আমার জন্য মুহুর্তটা তখন খুবই রোমাঞ্চকর! কারন মুন্না রাজী হওয়া মানে আমার ধারনা কাজ অর্দ্ধেক হয়ে যাওয়া। সে উদ্যোগ নিলে হাই কমান্ড রাজী হতে পারে। তাছাড়া আমি নিজে থেকেও যদি মুভ নেই তা মুন্নার নলেজে থাকা উচিত। মনে হলো দাউদকান্দি ফেরিঘাটে নয় যেন ইতিহাসের একটা টার্নিং পয়েন্টে আমরা দাঁড়িয়ে। হাতঘড়িটা টংঘরের আলোর দিকে বাড়িয়ে দেখি সময় সন্ধ্যা সাড়ে আটটা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই এই মুহুর্তটা কোনদিন ভুলবো না। জীবদ্দশায় কখনও তা লিখবো।
পরদিন অফিসে এসে কাজ শুরু করে দেই। কাজ শুরু মানে প্রথমেই মুকুল ভাইয়ের সাথে মত বিনিময়। তিনি এ উদ্যোগকে খুব একটা সুদৃস্টিতে দেখলেন বলে মনে হলো না। সম্ভবত: তার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতায় এসে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে দেয়া। অবশ্য তিনি এটা কখনও প্রকাশ করেননি। ভাবে ভঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। বিষয়টা নিয়ে ব্রিগেডিয়ার চিশতির সাথে খোলামেলা আলোচনা করি। তিনি সোজাসাপ্টা বলে দেন দেখ আমি রাজনীতি বুঝি না, এ ব্যপারে কিছুই বলতে পারবো না। কর্ণেল মুনিরের প্রটোকল সমস্যা ছিল। আমাদের মত হুটহাট সিনিয়রদের রুমে ঢুকে কাজের বাইরে কথা বলতে পারতো না। ফলে ব্যপারটা কয়েকদিন ওই পর্যন্তই ঝুলে রইলো।
’৮৪এর অক্টোবর মাসের ৩০ কি ৩১ তারিখে রাজনৈতিক দলগুলো সারা দেশে হরতাল ডাকে। মার্শাল ল’র মধ্যে সম্ভবত: প্রথম হরতাল এবং সর্বাত্মক সফল হরতাল। এই হরতালে নানা জায়গায় পুলিশের সাথে পিকেটারদের সংঘর্ষ হয়। ঢাকার জিরো পয়েন্টসংলগ্ন সচিবালয়ের দেয়ালের কিছু অংশ তারা ভেঙ্গে ফেলে। এই ঘটনা সরকারে বেশ রিপারকেশন সৃস্টি করে। সচিবালয়ের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলা- ঘটনাটাকে ছোট করে দেখার অবকাশ ছিল না। আমি নিজেও ভীষন ক্ষুব্ধ হই। ক্ষোভ থেকে ফোন করি কাছের মানুষ সুরঞ্জিত দা’কে। শুধাই, দাদা এগুলা কি শুরু করছেন? তিনি আমার চেয়ে দ্বিগুন ক্ষুব্ধকন্ঠে বলেন, তোমরা কি শুরু করছো? আমাদের বিরুদ্ধে আর্মি পুলিশ লেলাইয়া দিয়া দেশে একটা গৃহযুদ্ধ বাধাইতে চাও? আমি বলি, আপনারা যদি ভায়োলেন্সের পথ বেছে নেন সে ক্ষেত্রে ওরা কি করবে! দাদা বলেন, কি করবে এইটাও বইলা দিতে হবে! রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়া মোকাবিলা করতে হয় এইটাও জানো না! আমি বলি, তাহলে তো আমাদেরকে একটা পার্টি বানাতে হবে। তো বানাও না ক্যান? আমি বলি, তাহলে আমরা কিন্তু দাদা পার্টি বানায় ফেললাম। সুরঞ্জিত দা’ বলেন, দল নিয়া মাঠে নামো তারপর দেখা যাইবো কাদের শক্তি বেশী! দাদার সাথে এই কথোপকথন আমি চিশতি সাহেবকে জানাই।
এই হরতালের সময় এরশাদ সাহেব দেশে ছিলেন না। চার কি পাঁচদিনের জন্য শ্রীলংকা সফরে ছিলেন। ২ কি ৩ তারিখ তিনি ফেরেন। পরদিন আমি অফিসে গেছি, দেখি সারা অফিসে সুনসান নীরবতা। রুমে রুমে অফিসাররা বিমর্ষবদনে ¤্রয়িমান। অন্যান্ন দিনের তুলনায় গেস্ট বা ভিজিটর কম। কর্ণেল মুনিরের রুমে গিয়ে জানতে পাই সকালে চীফ অফিসে এসে সবাইকে বেশ ঝেড়েছেন। মার্শাল ল’র মধ্যে এতবড় হরতাল হলো কি করে! ঝাড়ি খেয়ে সবাই যার যার রুমে বসে আছেন।
এ সময় আমার কি হলো- চিশতি সাহেবের রুমে গিয়ে সড়াসড়ি বলি, স্যার আমি চীফের সাথে দেখা করতে চাই। এরশাদ সাহেব তখন সেনাবাহিনী প্রধান মানে আর্মি চীফ। অফিসাররা তাকে ‘চীফ’ বলতেন। আমরাও তাকে চীফই বলতাম। আমার কথা শুনে চিশতি সাহেব কিছুটা অবাক হন। বলেন, দেখা কইরা কি বলবা? বলি, পুরো সিচুয়েশনটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবো। কেন আজ এই পরিস্থিতির সৃস্টি এবং কিভাবে তা মোকাবিলা করা যায় এসব বিষয়ে আমার অপিনিয়ন তুলে ধরবো। চিশতি সাহেব কিছু ভাবেন, তারপর ইন্টারকম তুলে চীফের পিএস কর্ণেল শরীফকে ফোন করেন। বলেন, শরীফ চীফ কি করেন? শরীফ জানান তিনি রুমেই আছেন। চিশতি সাহেব বলেন, আমাদের তারেক চীফের সাথে দেখা করতে চায়, কি নাকি বলবে, দেখ তো ব্যবস্থা করা যায় কিনা। শরীফ দেখছি বলে ফোন রাখেন। একটু পর কলব্যাক করে বলেন, স্যার ২টার সময় যেতে বলেছেন। লাঞ্চে বাসায় যাবেন। তার আগে মিনিট দশেক কথা বলা যাবে। এ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেল। চিশতি সাহেব বলেন, দেখ বুঝাইয়া ঠান্ডা করতে পার কিনা।
সরকারপ্রধান সেনাপ্রধানের সাথে একান্ত মিটিং, তাও জীবনে প্রথমবারের মত, মনে হলোনা আমি খুব একটা উত্তেজিত আছি। মুকুল ভাই এবং মুন্নার সাথে বসে আলোচনার পয়েন্টগুলো ঠিক করে নেই। একটা ছোট চিরকুটে লিখেও নেই। একবার ভাবি মুন্নাকেও সঙ্গে নেব কিনা। না সেটা ঠিক হবে না। তাছাড়া মুন্নার প্রটোকল সমস্যা আছে। না ডাকলে সুপিরিয়রের কাছে এরা যেতে পারে না। চীফ সময় দিয়েছেন আমাকে, মুন্নাকে নয়। বেলা ঠিক দুইটায় পিএস কর্ণেল শরীফের রুমে গিয়ে হাজির হই। একটু বসতে বলে তিনি চীফের রুমে যান। ফিরে এসে আমাকে নিয়ে যান সেখানে। এই রুমে আমি আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি। তবে তখন ভবনটা মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার ছিল না, ছিল সংসদ ভবন। এখানে বসতেন বিএনপি আমলের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। সিএমএলএ’র অফিসকক্ষ হওয়ায় রুমটির বেশ সংষ্কার করা হয়েছিল। বেশ সাজানো গোছানো। সামনের করিডোরটাও কারুকার্যময়। রুমে ঢুকেই ব্যবহারকারির রুচীর পরিচয় পাওয়া যায়। কর্ণেল শরীফ আমাকে রুমে দিয়ে চলে যান। এরশাদ সাহেব তখন দাঁড়িয়ে গেছেন। বেরুবেন। ব্যস্ততার সাথে বলেন, হ্যাঁ বলো কি বলতে চাও, আমাকে এখুনি বাসায় যেতে হবে। আমি একটু থমকে যাই। বলি, স্যার দাড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলবো! ভদ্রলোক মানুষ। বলেন, ও হ্যাঁ বসো। বলে নিজেও বসেন। বলেন, খুব তাড়াতাড়ি বলো। আমি ধীরে ধীরে শুরু করি।
দেশের পরিস্থিতি, নেতাদের সাথে আমাদের আলোচনার ফলাফল, রাজনৈতিক দলগুলোর দাবী- আন্দোলন। পয়েন্ট বাই পয়েন্ট। এরশাদ সাহেব শান্ত হতে থাকেন। এক পর্যায়ে বেশ মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকেন আমার কথা। মাঝেমাঝে প্রশ্ন করেন। আমি উত্তর দেই। সময় গড়িয়ে চলে। তার ওঠার লক্ষণ নাই। এর মাঝে বাসা থেকে ফোন আসে। তিনি বলে দেন, ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ে আছি। শেষ করে আসছি। আধা ঘন্টার ওপরে আমি একনাগড়ে বলি। সব শুনে তিনি বলেন, এখন বলো তো এ পরিস্থিতিতে আমাদের কি করা উচিত। আমি সড়াসড়ি বলি, পলিটিক্যাল পার্টি গঠন। নেতাদের সাথে কথা বলে বোঝা গেছে তারা কেউ মার্শাল ল’ রেটিফিকেশনের দায়িত্ব নেবে না। আর রেটিফিকেশন ছাড়া মার্শাল ল’ তোলার কোন পথ নাই। এ অবস্থায় মার্শাল ল’ তোলা এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলার জন্য দল গঠনই একমাত্র পথ। সামান্যক্ষণ চুপ থেকে তিনি বলেন, ঠিক বলেছো। যত দ্রুত সম্ভব আমাদেরকে একটা পার্টি গঠন করতে হবে। তারপর তাদেরকে মাঠে নামাতে হবে।
এত সহজে যে তিনি রাজী হয়ে যাবেন বুঝতে পারি নাই। আমার ঘোর না কাটতেই বলে চলেন, এক কাজ কর- হুদা মতিনরা তো আমার দল করবে বলে দশ মাস ধরে বসে আছে। মাসে বিশ হাজার করে ওদের অফিস খরচাটাও আমার কাছ থেকে নিচ্ছে। ওদেরকে নিয়ে কালই একটা পার্টি ডিক্লেয়ার করে দাও! আমি খানিকটা দম নেই। বলি, শুধু ওদেরকে নিয়ে পার্টি করলে তো স্যার ওটা পলিটিক্যাল পার্টি হবে না। ওরা বসে আছে হালুয়া রুটীর আশায়, এটা একটা হালুয়া রুটীর পার্টি হয়ে যাবে। আমাদেরকে একটা ডিফরেন্ট টাইপের পলিটিক্যাল পার্টি গঠন করতে হবে। আদর্শভিত্তিক। সৎ এবং পোড়খাওয়া ত্যাগী নেতাকর্মীদেরকে নিয়ে। যারা আপনার রিফর্মসগুলোকে ধরে রাখবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই যদি না করি তাহলে বিএনপি’র সাথে আমাদের পার্থক্য থাকবে কি! এরশাদ সাহেব বলেন, সেটাও তো ঠিক। আমরা তো টাউট বাটপারদেরকে নিয়ে হালুয়া রুটীর পার্টি বানাতে পারি না। কিন্তু সেইরকম ত্যাগী সৎ আদর্শবান নেতা কর্মী পাবে কোথায়? বলি, আমাদেরকে সময় দেন, সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমন হাজার হাজার আদর্শবান ত্যাগী নেতা কর্মী ছড়িয়ে আছে, অনেকে হতাশায় ভুগছে। এদেরকে খুজে বের করে সামনে আনতে হবে। নেতৃত্বে বসাতে হবে। তাছাড়া শুধু কর্মী সমর্থক আনলেই হবেনা, জাতীয় নেতার ইমেজ আছে রাজনীতিতে অবদান আছে এমন কিছু নেতাও লাগবে, দলের ভাবমুর্তি বাড়ানোর জন্য। হুদা মতিনরা তো সেই মাপের জাতীয় নেতা নন। শুধু এদেরকে নিয়ে দল বানালে তো লোকে এটাকে আর একটা বিএনপি বলবে। এরশাদ সাহেব এই পয়েন্টেও একমত হন। ভাগ্য ভাল মাহবুবুর রহমানের ১৮-দফা বাস্তবায়ন পরিষদের কথা তোলেন নাই।
এরপর তিনি জানতে চান দলে তার কি পজিশন হবে। বলি, এটা তো পলিটিক্যাল পার্টি, এখানে আপনার পজিশন থাকবে কি করে! তিনি অবাক হয়ে বলেন, বলো কি! আমার দল তাতে আমিই থাকবো না? আমি বুঝিয়ে বলি, আপনি তো এখন আর্মি চীফ। আর্মি চীফ কি কোন পলিটিক্যাল পার্টির নেতা হতে পারেন! তা হতে হলে আপনাকে চীফের পদ থেকে রিজাইন করতে হবে। আপনি কি এখন তা করতে পারবেন! তিনি প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বলেন না না কক্ষনই না। আমি যোগ করি, তাছাড়া আগে আপনাকে পলিটিক্স বুঝতে হবে। পার্টি চালানো জানতে হবে। এ কথায় তিনি আমার দিকে হা হয়ে তাকান। বলো কি তুমি! আমি একটা সরকার চালাচ্ছি দেশ চালাচ্ছি আর্মি চালাচ্ছি আর পলিটিক্স বুঝি না! আমি বলি সামরিক সরকার চালানো আর পলিটিক্যাল পার্টি চালানো এক কথা নয় স্যার। কোন পলিটিক্যাল নেতাকে আর্মি চালাতে দিলে সে যেমন পারবেনা তেমনি কোন জেনারেলকেও পার্টি চালাতে দিলে পারবেনা- যতক্ষণ না সে পলিটিক্স এবং পার্টি বোঝে। এরশাদ সাহেব কিছু বলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধান, তাহলে এখন পার্টির চেয়ারম্যান কে হবে? আমি বলি, আমরা যে পার্টি গঠন করতে চাই তার নেতৃত্ব তৃণমুল থেকে গড়ে উঠবে। সারা দেশে কাউন্সিল করে নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় কমিটিগুলো গঠন করা হবে। এরাই ন্যাশনাল কাউন্সিল করে কেন্দ্রিয় নেতৃত্ব বা চেয়ারম্যান সেক্রেটারি নির্বাচিত করবে। এখন একটা কনভেনিং কমিটি থাকবে। চীফ আমার এ আইডিয়াটাও পছন্দ করেন। বলেন, ঠিক বলেছো, এটাকে একটা গনমুখী দল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে কনভেনর কে হবে? সে উত্তরও মাথায় ছিল। বলি, প্রেসিডেন্ট সাহেব। জিয়াউর রহমান সাহেব যেমন তার উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে দল গঠন করিয়েছিলেন আমরাও আমাদের প্রেসিডেন্টকে কনভেনর করে দল ঘোষণা করবো। দল গোছানো হয়ে গেলে, এর মধ্যে আপনি আর্মি থেকে রিজাইন দিলে, এসে পার্টির চেয়ারম্যান হবেন।
এরশাদ সাহেব লাল টেলিফোন তুলে কাউকে বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেবকে দাও। একটু পর ওপাশ থেকে কন্ঠ ভেসে এলে বলেন, আমি এরশাদ বলছি। প্রেসিডেন্ট সাহেব, আমরা একটা পলিটিক্যাল পার্টি গঠন করতে যাচ্ছি। আপনি হবেন এর কনভেনর। আমাদের মাস কন্টাক্ট সেলের তারেক এটা অর্গানাইজ করছে। ও আপনার সাথে দেখা করে সব বুঝিয়ে বলবে। দেশের প্রেসিডেন্ট তখন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী। একটু বেশীই বয়স। আলাভোলা টাইপের। বঙ্গভবনে ডাক্তাররা তাকে পাউরুটি খেতে দিতো না বলে নাকি তিনি ভেউ ভেউ করে কাঁদতেন! যাহোক, আমাদের দলের কনভেনর হয়ে গেল।
এর মধ্যে এরশাদ সাহেবের বাসা থেকে আরও একদফা ফোন আসে। বলে দেন, মিটিং শেষ হয় নাই। আমাকে বলেন, তাহলে কাজ শুরু করে দাও। আমি বলি, স্যার আপনাদের উদ্যোগে দলটা গঠিত হচ্ছে, তাছাড়া এতবড় একটা দায়িত্ব, এটা একজন সিনিয়র আর্মি অফিসারের নামে হোক। আসলে আমি চাইছিলাম এই প্রক্রিয়ায় ব্রিগেডিয়ার চিশতিকে সম্পৃক্ত করতে। এরশাদ সাহেব বলেন, আর্মি অফিসার এখানে কি করবে? আমি বলি, ধরেন অনেক বড় মাপের বা জাতীয় নেতাকে অফার করতে হবে। আমি বললে তারা অতটা গুরুত্ব নাও দিতে পারে। কিন্তু একজন জেনারেল বা ব্রিগেডিয়ার যদি প্রস্তাব দেয় তাহলে ফেলতে পারবে না। তাছাড়া এই মেসেজ তো দিতে হবে এটা আপনাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে। আমি দল বানাচ্ছি- এর কি কোন গুরুত্ব থাকবে! কিছুটা ভেবে তিনি বলেন, বেশ, কাকে তুমি চাও? বলি, স্যার ব্রিগেডিয়ার চিশতি হলে ভাল হয়। এতদিন তার সাথে কাজ করছি। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভাল। কাজ করতে সুবিধা হবে। তাছাড়া কর্ণেল মুনির আছে এমআর আকতার মুকুল ভাই আছেন, পুরো মাসকন্ট্যাক্ট সেল আছে, সবাই মিলেই কাজটা তুলে আনবো।
এরশাদ সাহেব ইন্টারকম তুলে চিশতি সাহেবকে আসতে বলেন। কয়েক মিনিটেই স্যার এসে হাজির হন। চীফ বলেন, শোন চিশতি, এই ছেলে তো আমার চোখ খুলে দিয়েছে। এতদিন তোমরা আমাকে এসব বলো নাই কেন! অনেক দেরী হয়ে গেছে, আমাদেরকে ইম্মেডিয়েটলি পার্টি ফর্ম করতে হবে। চিশতি সাহেব মুষ্ঠিবদ্ধ হাত এ্যাটেনশন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে স্যার স্যার বলতে থাকেন। তারেককে দায়িত্ব দিয়েছি, তুমি এই মিশনের লীড দেবে। চিশতি স্যার কাতর কন্ঠে বলেন, আবার আমাকে স্যার কেন এর মধ্যে ঢোকাতে চান। আমি পলিটিক্সের কি বুঝি! আমি বলি স্যার আপনাকে কিছু করতে হবেনা। যা করার আমরাই করবো, আপনি শুধু মিটিং কনফারেন্সগুলোয় এ্যাটেন্ড করবেন। পুরো কর্মকান্ডের খোজখবর রাখবেন। সবাই জানবে আপনিই এটা অর্গানাইজ করছেন। তারপরও চিশতি সাহেব ইযে ইয়ে করতে থাকেন। চীফের অর্ডার জারী হওয়ায় অগত্যা মেনে নিতে বাধ্য হন।
এরশাদ সাহেব বলেন, তোমাদের কি কি লাগবে আমাকে বলবে। আমাকে না পেলে- এতটুকু বলে ফোন তোলেন। ওপাশ থেকে কথা এলে বলেন, শোন মাহমুদ, আমরা ইম্মেডিয়েটলি একটা পলিটিক্যাল পার্টি ফর্ম করতে যাচ্ছি। তারেককে দায়িত্ব দিয়েছি। ওর যখন যা দরকার হবে প্রভাইড করবে। ফোন রেখে আবার অন্য নম্বরে ডায়াল করেন। একই কথা তিনি আর একজনকে বলেন। তারপর আমাকে বলেন, ডিজিডিএফআই ডিজি এনএসআইকে বলে দিলাম। তোমার যখন যা হেল্প লাগবে এদেরকে বলবে। এরপর তিনি জানতে চান সময় কতদিন লাগবে। আমি বলি, জাতীয়ভিত্তিক একটা পার্টি, অনেক বড় আয়োজন। অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হবে। ম্যানেজ করতে হবে। অন্তত: মাসতিনেক তো লাগবেই স্যার। তিন মাস? না না ইটস্ টু লং টাইম! অত সময় দেয়া যাবে না। বড়জোর একমাস সময় তোমরা পেতে পার। এর মধ্যে পার্টি ডিক্লেয়ার করতে হবে। এক মাস! আমি আর ব্রিগেডিয়ার চিশতি মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এরশাদ সাহেব বলেন, হ্যাঁ এমনিই অনেক দেরী হয়ে গেছে। কাজটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। যাও এখন থেকেই লেগে পড়। আমরা দু’জন সালাম জানিয়ে চলে আসি। চীফও ওঠেন। সময় তখন বিকাল চারটার মত।
লবিতে চিশতি স্যারের সাথে কোন কথা হয়না। রুমে এসে প্রথমেই একটা ঝাড়ি! দিলা তো মিয়া আমারে ফাসাইয়া! আমি পলিটিক্সের কি বুঝি! না কোন নেতা নেত্রীরে চিনি! আমি তাকে শান্ত করতে থাকি। তিনি বলেন যা করার কর, দেইখো আমি যেন কোন বিপদে না পড়ি। মুন্না এসে যায়। ধীরে ধীরে খবর হয়ে চলে আমরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছি।
জুলফিকর আলী ভুট্টো। সাবেক ছাত্রনেতা। মিজান আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। ডাকসুতে একবার ভিপি পদে নির্বাচনও করেছিলেন। এই ভুট্টোর সাথে আমার আগে থেকেই কিছুটা পরিচয় ছিল। সিএমএলএ সচিবালয়ে এসে দেখতে পাই মাঝেমাঝেই সে এখানে আসে। সঙ্গে থাকে ঢাকার দোহারের খন্দকার শহীদ। এরওর রুমে যায়। কথা বলতো বরিশালের আঞ্চলিক টানে। ছিল কিছুটা রসিক প্রকৃতির। হাসতে হাসতে কঠিন কথা বলে ফেলতো। অনেকদিন আগে থেকেই সে রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য চীৎকার চেচামেচি করে আসছিল। প্রায়ই কর্ণেল মুন্না ব্রিগেডিয়ার চিশতির রুমে গিয়ে উচ্চস্বরে বলতো, মোর কতা তো হোনবেন না, যেকালে হেইয়ারা রাস্তায় নামবেআনে হেইকালে বোঝবেন! সেই বিকেলে ভুট্টোকেও পাই অফিসে। কখন এসেছে জানিনা তবে এসে খবর পেয়েছে আমি আর চিশতি সাহেব দীর্ঘক্ষণ চীফের সাথে মিটিং করছি। রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছিল মুকুল ভাইয়ের রুমে। মুকুল ভাইও ছিলেন। সবার সাথে কথা বলি। প্লানিংয়ে বসে যাই। সময় অল্প কাজ অনেক। মুকুল ভাই দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। আওয়ামী ঘরানার লোক। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সম্পর্কে তার ধারনা ছিল। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিভিন্ন এলাকার কমপক্ষে এক শ’ নেতা কর্মীর একটা তালিকা করতে যারা সৎ, দল এবং আদর্শের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। মুল্যায়িত না হয়ে বা কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে আছেন। আওয়ামী লীগে ঠাঁই হয় নাই অথচ দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা এখনও বুকে লালন করেন। মুকুল ভাই বলেন কোন সমস্যা নাই আমি সবাইরে জানি। কাইলের মইধ্যেই লিস্টি কইরা ফালাইতেছি।
এরপর প্রশ্ন আসে নেতা কাদেরকে আনা যায়। একটা ব্যপার বুঝতে পারছিলাম হুদা-মতিনদেরকে এড়ানো যাবে না। ওরা এসে পড়বেই। যদিও এদের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের কোন নেতা নাই তারপরও ইম্মেডিয়েট পাস্ট গভর্ণমেন্ট পার্টির একটা অংশ। প্রায় ৪৫জন সাবেক এমপি ছিল এদের সাথে। এরা এসে গেলে দলে এবং নির্বাচনে এদেরই অগ্রাধিকার থাকবে। ভুট্টোকে বলি আপনার নেতার খবর কি? ভুট্টোর নেতা মানে সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা অভিজ্ঞ পার্লিয়ামেন্টারিয়ান মিজানুর রহমান চৌধুরী। ’৭৯-এর নির্বাচনের আগে তিনি নীতি আদর্শের প্রশ্নে দ্বিমত করে পৃথক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। সে নির্বাচনে তিনি এবং তার দলের এ বি সিদ্দিক জিতে এমপি হয়েছিলেন। মার্শাল ল’ হওয়ার পর থেকে প্রায় চুপচাপই ছিলেন। ভুট্টোকে বলি দেখেন তো উনার সাথে কথা বলে আমাদের সাথে আসতে রাজী হন কিনা। অন্যরাও বলেন মিজান চৌধুরীকে পেলে দলের ভাবমূর্তি অনেক বেড়ে যাবে। ভুট্টো বলে তার সাথে কথা বলবে। আর একজন বাগ্মী নেতা ছিলেন শাহ মোয়াজ্জম হোসেন। দক্ষ সংগঠক। কিন্তু সমস্যা ছিল তিনি খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিলেন এবং মোশতাকের দল ডিএল বা ডেমোক্রেটিক লীগ নিয়ে বসে ছিলেন। আমরা কোন বিতর্কিত লোককে দলে নিতে চাইছিলাম না। তারপরও বিশেষ বিবেচনায় তার সাথেও কথা বলার সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিক আলোচনার জন্য ভুট্টোকে সে দায়িত্বও দেওয়া হয়।
পরদিন সকাল ৮টা হবে, টেলিফোনে রিং। সে কালে মোবাইল ছিলনা ল্যান্ডফোনই ভরষা। এত সকালে কার ফোন চিন্তা করতে করতে উঠে ধরি। ওপাশ থেকে কন্ঠ ভেসে আসে, আমি এরশাদ বলছি। শোন, কাল বলেছিলাম এক মাসের মধ্যে পার্টি বানাবে। অত সময় দেয়া যাবেনা, পনের দিনের মধ্যে পার্টি ডিক্লেয়ার করতে হবে। আমি জ্বী স্যার জ্বী স্যার, এসে সাক্ষাতে কথা বলছি বলে ফোন রাখি। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে! পনের দিন মানে দুই সপ্তাহ। এত অল্প সময়ে কিভাবে সম্ভব! দ্রুত রেডি হয়ে পড়িমড়ি এসে হাজির হই অফিসে। ব্রিগেডিয়ার চিশতি রুমেই ছিলেন। আমি প্রবেশ করতেই বলেন, এখন ঠ্যালা সামলাও। তার মানে এরশাদ সাহেব তাকেও বলেছেন। আমি বলি, তাড়াহুড়া করলে তো স্যার কোন ভাল পার্টি বানানো যাবে না। তিনি বলেন কি আর করবা। পারলে চীফেরে বোঝাও। ওই বোঝাতে যাওয়ার সাহস আমারও হচ্ছিল না। সকালে টেলিফোনে যে ভাব বুঝেছি তাতে বোঝাতে গেলে ফল উল্টো হয়ে যেতে পারে। তারপরও তিনি অফিসে এলে কর্ণেল শরীফকে বলে একবার যাই রুমে। সকালের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন আর সময় নস্ট করবে না, কাজ শুরু করে দাও। আমি বলি কাজ আমরা শুরু করে দিয়েছি স্যার। কয়েকজন জাতীয় নেতার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, সারা দেশে বিভিন্ন দলের ভাল ভাল নেতা-কর্মীদের তালিকা করা হচ্ছে। সবার সাথে কথা বলে দ্রুতই পার্টি ঘোষনা করে দেয়া সম্ভব হবে। জাতীয় নেতার কথা শুনে জানতে চান কার কার সাথে কথা হয়েছে। বলি মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম- আপাতত: এদের কাছে লোক পাঠিয়েছি। মিজানুর রহমান চৌধুরীর কথা শুনে এরশাদ সাহেব অবাক হয়ে যান। বিষ্ময়কন্ঠে বলেন মিজান চৌধুরী আমাদের দলে আসবেন! তিনি এলে তো খুবই ভাল হয়। আমি আশ্বস্ত করি- আমরা চেষ্টা করবো। আরও কিছু নেতার সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে, কারও সাথে কথা ফাইনাল হলেই জানাবো। আলাপের শেষ পর্যায়ে ইঙ্গিত দিয়ে আসি গোছগাছ চুড়ান্ত করার প্রয়োজনে সময় দুই একদিন বাড়তে পারে। তবে চেষ্টা করবো সপ্তাহদু’য়েকের মধ্যেই ফাইনাল করতে।
মেজর জলিল জাসদের সভাপতি ছিলেন। শুধু সভাপতি নন তিনি ছিলেন এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। যুদ্ধের পরপর বিদেশী লুটপাটের প্রতিবাদ করার দায়ে দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। শাস্তিস্বরূপ তাকে কোন রাস্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয় নাই। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রতিবাদী কন্ঠ হিসেবে তার ভাল ইমেজ ছিল। আমার সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল। অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। সে সময় তিনি জাসদ ছেড়ে কি একটা ইসলামিক দল করছিলেন। ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে ফোন দেই। চায়ের দাওয়াত দেই। জলিল ভাই আসেন আমাদের অফিসে। কর্ণেল মুন্নার রুমে বসে কথা হয়। দল গঠনের কথা জানাই এবং তাকে আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করি। জলিল ভাই কথা বলতেন আস্তে আস্তে, অনেকটা নীচুস্বরে। সব শুনে জানতে চান এই দলের সভাপতি কে হবেন। বলি আপাতত: আমরা একটা কনভেনিং কমিটি দিয়ে শুরু করবো। পরে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হবেন। চালাক মানুষ। বলেন, সেসব বুঝলাম কিন্তু পার্টির চীফ হবে কে? বলি একসময় তো এরশাদ সাহেবই দলের হাল ধরবেন। তিনি বলেন, হবে না। আমাকে যদি সভাপতি বানাও তাহলে চিস্তা করে দেখতে পারি। জলিল ভাইয়ের সাথে কথা আর এগোয় না। জানাবো বলে চা খাইয়ে বিদায় করি। (চলবে)