অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের শান্তি
- প্রকাশের সময় : ১১:১৭:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মার্চ ২০১৮
- / ৯৩২ বার পঠিত
আবু জাফর মাহমুদ: বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসের সপ্তাহে যুদ্ধদিনের স্মৃতিভরা মনে লিখতে বসেছি দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান নিয়ে। সেদেশের যুদ্ধ থামানোর জন্যে বৈঠক চলছে। সুখবর, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে এসেছে। একঠিন কাজটি সাধ্য করেছেন দেশবাসীরা।
অস্থিতিশীল বাংলাদেশের মানুষ উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধির প্রতিযোগীতায় পৃথিবীময় সম্প্রসারিত করে চলেছে নিজেদের কর্মস্থল ও বাসস্থান। বিদেশে পৌঁছেই কর্মঠ বাংলাদেশী বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বাংলাদেশকে ঠেলে তুলে নিয়েছে উন্নততর পর্যায়ে। নিজদেশে ভাঙ্গারাস্তাগুলোয় নিরাপত্তাহীনতা অতিক্রম করে গমনাগমন করছেন দুনিয়ার উন্নত পথে। আলিঙ্গন পেয়ে চলেছেন অত্যাধুনিক টেকনোলজির।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের এরকম সুদিনের খবরের মধ্যেই একাত্তরের প্রতিটী স্বাধীনতাযোদ্ধার আতœদান ও ত্যাগের স্বার্থকতা। উক্ত আনন্দের কৃতিত্ব কেড়ে নেয়ার রাজনীতি যতই উদারতাহীন হউক,বাংলাদেশ তার মর্যাদাশীল গন্তব্যে পৌঁছবেই।২০০৬ সালে বাংলাদেশে একটি পত্রিকার সাথে আমার সাক্ষাৎকারের প্রচ্ছদ শিরোনাম ছিলো “বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি”।
প্রতিবেশী আফগানিস্তান যুদ্ধপীড়িত এক বিশাল দেশ। এই দেশ নিয়ে যে সংঘাত চলে আসছে তার সাথে বৈশ্বিক সামরিক-রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক কারো অজানা নয়। ওখানকার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সরাসরি দেখিয়ে দিচ্ছে সরকারে কে থাকবেন বা কাকে রাখা হবে, তা ঠিক রাখেন বিশ্বের প্রভাবশালী নীতি নির্ধারকরা। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার হটিয়ে তাদেরকে নির্মূল করতে আমেরিকা এবং তার ন্যাটোমিত্রেরা সরাসরি আক্রমণ করেছিলো।
তার আগে রাশিয়াপন্থী কম্যুনিষ্ট সরকার বিদায় দেবার অজুহাতে তালেবানী বিদ্রোহীদেরকে গঠন, প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধাস্ত্রে সামর্থ্যবান করে যুদ্ধে সহায়তা দিয়েছিলো আমেরিকা-পাকিস্তানী সামরিক জোট। তালেবানরাও আফগানী। তাদেরকে সরকার থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার দীর্ঘ যুদ্ধে অসংখ্য সেনাশক্তি হারিয়ে এবং এতে আরো শক্তি আমদানি করেও আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট বিজয়ী হতে পারেনি। বরঞ্চ এই যুদ্ধে তাদের পরাজয় যেনো ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছেনা। ইতিমধ্যে পাকিস্তান-আমেরিকার মধ্যেকার সম্পর্কের মিত্রতা উলটে গেছে।
দেশটার চলমান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশে রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাবের রাজনীতি লক্ষ্যণীয়ভাবে স্পষ্ট হয়েছে প্রকাশ্যে। পাকিস্তানে নেওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ও রাজনীতি থেকে সরানো হয়েছে, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এবং ক্রিকেটার ইমরান খাঁকে সামনে না হয়েছে। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেও লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে না পেরে কংগ্রেসকে আবার পৃষ্টপোষকতা দিয়ে উপরে টানা চলছে। ভারতকে প্রধানমিত্রদেশরূপে অবস্থান নিয়েছে আমেরিকাও তার মিত্রেরা।
বাংলাদেশে ইসলামিক শক্তির বিপক্ষরূপে পরিচিত রাজনৈতিক শক্তিকে সরকারে একক ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী করা হয়েছে এবং ইসলামিক শক্তি বা তার নির্ভরযোগ্য মিত্রদের সমাজ ও রাজনীতির বলয়ে প্রাণহীন করা হয়েছে। এদেশে ইসলামিক রীতি-নৈতিকতাকে নির্মূলকারীদেরকেই ক্ষমতাধর করা হয়েছে। রাজনৈতিক চিত্রের এই দৃশ্যের বিপরীতে আরেক দৃশ্যের আবির্ভাব ঘটেছে দক্ষিণ-মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়। এতে চীন-রাশিয়া-ইরান বলয়ের একটা বিশাল উত্থান হয়ে গেছে। ভারতকে চারিদিকে ঘিরে ফেলেছে চীন।
কেবলমাত্র বাংলাদেশে ভারতের অবস্থান সম্প্রচারিত দেখা গেলেও তা আছে মূলতঃ সরকারে। সরকার হয়ে আছে জনবিচ্ছিন্ন এবং চরম ঝুঁকির অস্থিরতায়। নিজেদের মধ্যে একে অপরকে সন্দেহের রোগে আক্রান্ত হয়ে টিকে আছে এক ধরণের কট্টর মেজাজে। রাজনৈতিক সাংগঠনিক ধারা আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গসংগঠন গুলোয় অনুপস্থিত বলে বিভিন্নভাবে খবর আসছে। সরকারী ক্ষমতা ও ধনী হবার দিকেই দলের লোকদের মূল ঝোঁক এখন।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষতাও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে আমেরিকা-চীন-ভারত-সৌদি-ইরান-ইওরোপের সাথে ভারসাম্য করে অগ্রসর করার একটা চিন্তাভাবনাও চলছে ভেতরে ভেতরে। ওয়ান এলেভেন গ্রুপ বলে খ্যাত সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএনপি ভীতি চরমে বিধায় তার ভারত মহাসাগরে চীন বনাম ভারতের আধিপত্যের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। তবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার অবশিষ্টাংশ নির্ভর করছে রাষ্ট্রটির নিরাপত্তাগত স্বার্থের সাথে ভারতও আমেরিকার মনোভাবের উপর। চীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় নয়। এখানে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে জেলখানায় থাকতে হবে এবং তার ছেলে তারেক জিয়াও রাজনীতি পরিবর্তনে ফ্যাক্টর হতে পারছেনা নিজস্ব বলয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক সহকর্মীর অভাবে যারা আন্তর্জাতিক মহলে দলের পক্ষে অবদান রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশের সেনাশক্তির মেধাকে রাজনীতির প্রতিপক্ষ করার চেষ্টা রয়েছে পাকিস্তানের মতো।
রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত করে যেসব দেশ রাষ্ট্রকাঠামো সাজিয়েছে তাদের ভিত্তিতে আঘাত হলেও এই আঘাত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে। অর্থনৈতিক অগ্রসরতাকে নিরাপদ করতে পারে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বরত শক্তি। রাজনৈতিক শক্তির সাথে এই শক্তির আন্তঃযোগাযোগের উপর তা নির্ভর করছে। ইজরাইলের সেনাশক্তি দুনিয়ার সেরা সামরিক শক্তিতে পরিণত হবার পেছনে রয়েছে সেদেশের রাজনৈতিক চিন্তার কার্যকর সহায়তা। পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর লোকদের মৃত্যুর পরও রাষ্ট্র তাদের পরিবারের সহায়তা কমায়না।
বাংলাদেশে সেনাশক্তির মেধাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির যাত্রায় স্বাধীন বিকাশের রাজনীতির সংযোজন হতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পেছনের কাতারের ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে বেশী সমাদর করে রাজনৈতিক অঙ্গনকে কেবল বক্তৃতা, প্রতারণা, চোরাচালান, হুন্ডি ইত্যাদি নির্ভর করায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে অক্ষমতা বাংলাদেশে মহামারির আকার ধারণ করেছে। যেমন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার রেকর্ড বাজানো ছাড়া আওয়ামী লীগের নিজস্ব রাজনীতির উপস্থাপনা পাওয়া যায়না।
সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হীনতা সহ প্রচুর রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা, ইসলামের নামে আবেগ বাগিয়ে নিয়ে অরাজনৈতিক তৎপরতা, গণতান্ত্রিক নৈতিকতার বিরুদ্ধাচরণে বিশেষ মাস্তানী-নির্ভর দলীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশকে অরাজকতায় পরিণত করেছে। তবুও সামনে চলার অঙ্গীকারে প্রচন্ড মনোবলে বলিয়ান বাংলাদেশীরা নিজের দেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে আতœমর্যাদার চাবিকাঠি বলে জ্ঞান করেন। এই বৈশিষ্ট্যকে বাংলাদেশের শত্রুরা বাংলাদেশ লুন্ঠনের জন্যে ব্যবহার করতে পারছে, বাংলাদেশ কেনো পারবেনা নিজের কল্যাণে?
আসা যাক, আফগানিস্তান প্রসঙ্গে। আফগানিস্তানে আমেরিকা সহ ন্যাটোর শক্ত অবস্থান আছে। বিদেশী চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা ইরাক সিরিয়ায় মার খেয়ে এখানে তৎপরতা চালাচ্ছে। তালেবানরা সশস্ত্র যুদ্ধ করছে তাদের প্রভাবিত এলাকা থেকে। গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের বাহিনী আছে সরকারে নিজস্ব রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার নীতিতে। বিভিন্ন গোষ্ঠীগত বিভেদ বিভক্তির বিবাদে ভিন্নভিন্ন মতের রাজনৈতিক সমীকরণে তারা অঞ্চল ভিত্তিক প্রভাব বিস্তার করে আছে। যুদ্ধরত আফগানিস্তানে শান্তি যেনো ফিরতে ভয় পায়। যদিও ওখানে শান্তি স্থাপনের জন্যে চীন-রাশিয়া-ইরান-পাকিস্তান স্থানীয়দের সাথে সভা করেছে কয়েকবার। এরা হলো আফগানিস্তানের সাথে সীমান্তের দেশ।
হেকমতিয়ার বলছেন তিনি চাইছেন তালেবানদের জন্যে নির্দ্দিষ্ট অঞ্চল যেখানে পশতুন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস বেশী। তালেবানদেরকে নিরস্ত্র করার ব্যাপারে তার এই প্রস্তাবের সাথে সরকারের অনেকের আপত্তি আছে। তবে তার এই প্রস্তাব পশতুন জাতির কাছে বেশ সমাদৃত বলে জানা গেছে। গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ার একজন প্রকৌশলী এবং যোদ্ধা পরিচয়ে তার খ্যাতি রয়েছে। তিনি আগামীতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আফগান সরকারের শান্তি প্রক্রিয়ায় অবদান রাখছেন তিনি। তিনি তালেবানদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্যে সর্বোচ্চ শান্তি কমিটিকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছেন।
২৫ থেকে ২৭ মার্চ উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসকেন্তে আফগান সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে শান্তি আলোচনা চলছে। স্থানীয় দেশের সরকারের সাথে আফগান সরকার হয়েছেন কো-হোষ্ট। রোববার ২৫ মার্চ মধ্য এশিয়ার ৫ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বসার কথা। তবে পূর্ণ অধিবেশনে এরা ছাড়াও আরো যাদের প্রতিনিধি অংশ নেয়ার কথা তারা হচ্ছেন, জাতিসংঘ, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইওরোপীয়ান ইউনিয়ন, জার্মানী, ফ্রান্স, ইটালি, ইউনাইটেড কিংডম, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, তার্কি, ইরান, সৗদি আরব এবং আরব আমিরাত।
এই বৈঠকের আগে অনেক বৈঠক হয়েছে আফগান শান্তি উদ্যোগের। কোয়াড্রিলেটারেল কোওর্ডিনেশন গ্রুপের চার সদস্য; আফগানিস্তান, পাকিস্তান চীন এবং আমেরিকা ২০১৬ সালে জানুয়ারীতে বসেছিলো। আবার ফেরুয়ারীতেও হয় বৈঠক। ওমান পাকিস্তান তাসকেন্ত সহ বিভিন্ন স্থানে এই শান্তি আলোচনা হয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্টে আশরাফ ঘানির একান্ত প্রতিনিধিরা সব সময় বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
এদিকে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আফগানিস্তানে দায়িত্বরত আমেরিকান জেনারেল নিকোলসন বলেছেন, রাশিয়া তালেবান বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করছে তাজিকিস্তানের সীমান্ত পথে। রাশিয়া আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। অবশ্য রাশিয়ার কর্মকরতারা এই দাবিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। তারা একথাও বলছেন, আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে তালেবানদের সাথে তাদের সীমিত যোগাযোগ আছে।
এদিকে পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতা ক্রিকেটার এমরান খাঁ সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গোলযোগপূর্ণ আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। ট্রাম্প সরকারের আফগান নীতি পরিবতর্ন করা দরকার। ন্যাটো বাহিনীর দেড় লাখ সেনা যেখানে কিছুই করতে পারছেনা ট্রম্পের বাড়তি সৈন্যেরা কি কিছুই করতে পারবে? আফগানিস্তানে ঐক্যমতের সরকার গঠন করতে হবে এবং এজন্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, চীন, ইরান ও রাশিয়ার একমত হয়ে কাজ করতে হবে।
(লেখক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতাযোদ্ধা)।