নিউইয়র্ক ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞাপন :
মঙ্গলবারের পত্রিকা সাপ্তাহিক হককথা ও হককথা.কম এ আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন +1 (347) 848-3834

সুন্দরবনের দিবানিশি

রিপোর্ট:
  • প্রকাশের সময় : ০১:৫০:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫
  • / ১৩৯ বার পঠিত

Untitled design - 42

সতীর্থ শ.ম. শহীদ (মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ)

১. দুনিয়ার তাবৎ কটাল পললভূমির বাদাবনের মধ্যে এক অনন্য অপরূপ নিভৃত অরণ্য এই সুন্দরবন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল হতে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ-পুব উপকূল অবধি বিস্তৃত এই বন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট। সমস্ত সুন্দরবনের দুই তৃতীয়াংশ, ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার, বাংলাদেশে। নিত্য দু’বেলা জোয়ারের পানিতে ডাঙ্গার অনেকটুকুই ডুবে যায়। আর বর্ষাকালে ভরা কটালে প্রায় সমস্ত বনই প্লাবিত হয়। আর এতো পানি- বনের ৩১ ভাগই নদী, খাঁড়ি আর খাল-অথচ এর এক আঁজলাও পান যোগ্য নয়। এসব নদী, খাঁড়ি, নালার সবকটিতেই দক্ষিণ সমুদ্রের লোনা পানির অবাধ সমাগম। বনের পশ্চিম এলাকার পানি তীব্র লোনা, পুবে কম। জোয়ার-ভাঁটার দাপট, মাটি ও পানির লবণাক্ততা, আর উষ্ণ আর্দ্র মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এই ভাঁটি এলাকার গাঙ্গেয় দ্বীপাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে এক আশ্চর্য বাদাবন বা ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট। সুন্দরী, গেওয়া, পশুরের উর্দ্ধমুখী শ্বাসমূল বা শূলো আর কাঁকড়া, গরান, খালসীর বাঁকানো ঝাঁকড়া শেকড়ের জটলা বনভূমিকে করেছে দুর্গম। ডাঙ্গায় আগুনে বর্ণের মসৃণ গাত্রে, কালো ডোরাদার রাজকীয় বাংলার বাঘ, অপূর্ব সুন্দর মায়াবী চিত্রল হরিণ, ডাঙ্গা আর বৃক্ষ পল্লবে আইরাজ (অহিরাজ) বা শঙ্খচূড়, গোখরা, কেউটে, কালাজ, চন্দ্রবোড়া আর ময়াল আর নদী-নালা, খাঁড়িতে কামট-হাঙ্গর-কুমির এই সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গরান আর হেঁতালের দুর্গম বিশাল বাদাবনকে করেছে মনোহর, ভয়ঙ্কর, রোমাঞ্চকর আর রহস্যময়।
দুনিয়ার প্রায় সবকটি ম্যানগ্রোভ জঙ্গল দেখার পর পঁয়ষট্টির পৌঢ়ত্বে এসে সুন্দরবন দেখে হতবাক হয়ে যান ম্যানগ্রোভ বন আর মধু বিশারদ নেদারল্যান্ডের জিনি ডি বিয়ার। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ফরেষ্ট রিসার্চের নির্বাহী প্রধান আর ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন ফর ন্যাচারের (IUCN) নেদারল্যান্ড শাখার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জিনি ডি বিয়ার। সুদীর্ঘ কর্মজীবনের শেষ লগ্নে এসে সুন্দরবন দেখে ধরা গলায় বললেন, ‘অসাধারন সুন্দর! এই বনে না এলে আমার এতো বছরের জীবনের সব জ্ঞান তুচ্ছ হয়ে যেত।’
বাংলাদেশের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ এই সুন্দরবন দেখে মধু আহরণ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ সুন্দরবন সম্পর্কে ডি বিয়ার তাঁর পর্যবেক্ষণ, পরামর্শ রেখে যাবেন। তবে এসবের বাস্তবায়ন কতোটুকু হবে তা কে জানে? (ইফতেখার মাহমুদ: ‘স্বপ্ন যাঁর মধুর দুনিয়া’। সুন্দরবনের ইতিহাস-২, ২০০৭। সম্পা, রাজিব আহমেদ, গতিধারা, পৃ: ৪০৭, ৪০৮)।
নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত লক্ষœণ সেরেস্তা জং বাহাদুর ঝাঁপা আর কাগাবগা খালের সঙ্গমের বনে হরিণের ঝাঁক আর পাখ-পাখালীর আরণ্যক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গভীর আবেগে বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর বহু দেশ দেখেছি, আমাদের নেপালেও প্রচুর বন জঙ্গল পাহাড় রয়েছে। যেখানে আমি ব্যাপকভাবে ঘুরেছি। কিন্তু এমন স্বর্গীয় দৃশ্য জীবনে আমি কখনো দেখিনি। সত্য বলতে কী সুন্দরবনের কোনো তুলনা নেই। আমি আমার হিজ ম্যাজেষ্টি রাজা মহেন্দ্রকে এ সুন্দরবন দেখার জন্য অবশ্যই অনুরোধ জানাবো।’ পরবর্তী কালে ১৯৬৭ সালে তারই প্রচেষ্টায় নেপালের মহারাজা মহেন্দ্র সপরিবারে সুন্দরবন ভ্রমণে এসেছিলেন। পর্যটনের ক্ষেত্রে আজ নেপালের যে ঐতিহাসিক উন্নতি ঘটে তার সূচনা ঘটে মহারাজার সুন্দরবনের তিনকোনা দ্বীপের মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে। (আখতারুজ্জামান কামালঃ ‘বিপন্ন সুন্দরবনের তিনকোনা বনদ্বীপে ভ্রমণ। সুন্দরবনের ইতিহাস-২, ২০০৭। সম্পা, রাজিব আহমেদ, গতিধারা, পৃঃ ৪৫৬, ৪৫৭)।
আমাদের দেশের কোনো কোনো শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী-গুণীজনও সুন্দরবন আর এর বিপন্ন প্রাণীকুলকে হতশ্রদ্ধা করেন। তাঁরা দেশের এই অমূল্য সম্পদ বাদাবনের মাটি-পানি-প্রাণী-উদ্ভিদের অপূর্ব সম্মিলনের বা এর জটিল সামগ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে খবরাখবর কতোটুকু রাখেন আমার জানা নেই। কথায় বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। আমরা এখন সদর্পে নেমেছি তাৎক্ষণিক নগদ লাভের উন্মাদনায় প্রকৃতির এই অতুলনীয় সম্পদ সুন্দরবনকে উচ্ছেদ করতে। বনের ক্ষতিকর দূরত্বের মধ্যে দূষিত বর্জ্য নিঃসারক কলকারখানা বসাচ্ছি। সুন্দরবনের মাটি, নির্মল বায়ু আর বনের শোণিত প্রবাহতুল্য নদী-নালার পানি দূষিত করতে উঠেপড়ে লেগেছি। বনের গাছপালা, বিপন্ন দুষ্প্রাপ্য পশুপাখী, জলজ সম্পদ ধ্বংসের হালখাতা খুলেছি দৃশ্যত নগদ প্রাপ্তির মোহে, আর অন্তরীক্ষে কাদের স্বার্থে, কাদের ইন্ধনে, কে জানে?
সুন্দরবনের বাওয়ালি, জেলে, মৌয়াল, জোংড়াখুটা আর বনরক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে, তাদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের বিষয়ে সুলেখক হুমায়ুন খান সুন্দরবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বাস্তবধর্মী পরামর্শ রেখেছিলেন বন বিভাগ তথা সরকারের উদ্দেশ্যে, তার তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ ‘সুন্দরী সুন্দরবন’-এ। (হুমায়ুন খান: ‘সুন্দরী সুন্দরবন’। সুন্দরবনের ইতিহাস-১, ২০০৭। সম্পা, রাজি আহমেদ, গতিধারা, পৃঃ ৫৪৭, ৫৪৮)। এসব সুপারিশ পরামর্শ এতদসম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, ডিপার্টমেন্টের নীতি-নির্ধারকদের সক্রিয় বিবেচনায় এনে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক।
২. সেদিন সারাটা বিকাল কটকায় একটি মাছিও চোখে পড়েনি। তামাম বন যেন খালি। বাঘতো দূরের কথা, একটা হরিণও যদি চোখে পড়তো। লুকোচুরিতে বাঘ ঘাগুমাল। তার প্রয়োজনে দেখা দিতেও পারে। তবে শিকারতো সে চুপিসারেই সারে। নেহাৎ আবশ্যিক না হলে সে হই হুল্লোড়ের মধ্যে নেই। বাঘ দেখা ভাগ্যের কথা। মানে নিজে একশোভাগ নিরাপদে থেকে দেখা আরকি। নতুবা না দেখাই মঙ্গল। কথায় বলেনা, ‘বাঘের দেখা আর সাপের লেখা!’
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাট সারা সেই কখন। তারপর সমুদ্রের স্বাস্থ্যপ্রদ লোনা হাওয়াও খাওয়া হল খানিকটা। এবার গা তোলার সময়। কটকা থেকে বের হচ্ছিলাম দলে বলে। কোথাও হরিণ দেখলাম না সেবার। একটা মুরগী কী কাক পক্ষীও নয়। অথচ স্থানীয় বনরক্ষীরা বলছেন কটকার হরিণ নাকি লোকজনের হাতে ধরা ভাঙ্গা ডাল থেকেও কেওড়া পাতা খেতে চলে আসে। আর বাংলোটার মাচানের নিচ পর্যন্ত নাকি মামাও ভিজিট করেন রাত বিরাতে। বাংলোর মাচানের নিচে অল্পস্বল্প ভিজে মাটিতে হরিণের খোঁচ দেখেছি বিস্তর। বাঘের পাগমার্ক বা পায়ের ছাপ চোখে পড়েনি।
সে দিন হরিণ দেখতে না পাওয়াতে আমার আফসোস দেখে এক তরুণ ফরেষ্ট গার্ড দারুণ এক সল্লা দিলেন। ঘাট ছাড়তে একপা বাড়ানো লঞ্চটাতে তখুনি না চড়ে তার সাথে স্পীডবোটে করে কটকার উল্টো দিকে কচি খালের পাড়ে হরিণের খোঁজে যেতে। হরিণ দেখা হলে স্পীডবোটে জোর কদমে কটকা খালের উজানে গিয়ে চলন্ত লঞ্চ ধরা যাবে। তথাস্তু! সঙ্গীদের খবরটা দিয়ে বন্দুক আর তিন সেলের টর্চটা নিয়ে স্পীডবোটে চড়লাম। সামান্য উজানে গিয়ে ডানে মোড় নিয়ে কচিখালের দক্ষিণ পাড়ে উঠলাম দু’জনে।
ডাঙ্গায় উঠতেই দেখা হল বাপ-বেটা দুই বাওয়ালির সঙ্গে। বাপ মাঝ বয়েসী, ছেলেটা কিশোর। তারা সদ্য কেটে আনা কাঠ গোছাতে ব্যস্ত। গাটাও ধুয়ে নিচ্ছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কনে দেখা অন্ধকার। বড়ো বাওয়ালির সাথে কথা হলো।
বাপ-বেটা বাওয়ালি দু’জন পুবে কচিখালের গভীরে গিয়ে কাঠ কেটে কটকার দিকে আসছিলেন। বড়ো কাঠুরিয়ার জবানে- শয়তানটা খালের দক্ষিন পাড় ধরে ডিঙ্গির পিছু নেয়। তারাও খালের ডানপাড় ঘেঁষে ডিঙ্গি জোরে চালিয়ে দূরত্ব বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু শয়তানটা নাছোড়বান্দা। শিকার একটা ধরবেই। কচিখালের পশ্চিমে কটকার বড়ো খালের কাছাকাছি ডিঙ্গি পৌঁছলে বাঘ গা ঢাকা দেয়। বড়ো বাওয়ালিকে শঙ্কিত মনে জিজ্ঞেস করলাম, সদ্য বাঘের তাড়া খেয়ে বড়ো খালের মুখে এসে বাঘের ধাওয়া করা পাড়েই এই ভর সন্ধ্যায় কাঠ গোছানো, গা-ধোয়ার কাজগুলো ঝুঁকিজনক হয়ে যাচ্ছে না? বাওয়ালি তেমন একটা গা করলেন না, উল্টো আরেকখানা গল্প শোনালেন।
ভাইয়ের সাথে ডিঙ্গি বাইতে গিয়ে সুন্দরবনের খালে নেমে ডিঙ্গির এক পাশের ফুটো মারতে গোঁজ দিচ্ছিলেন নিজেই। ভাই নৌকার ভেতরটা দেখছিলেন। আচমকা পিঠের বাঁ পাশটা কামড়ে ধরে একটা কুমির, হেঁচকা টানটা দেবার আগেই বাওয়ালি ডিঙ্গির কিনার জাপটে ধরে ফেলেন। আর ভাইকে বলেন দড়ি ফেলে কুমিরকে আটকাতে। লড়াইয়ের এক ফাঁকে কুমিরের গা গলিয়ে মজবুত দড়ির বাঁধনে কুমিরকে আটকে ফেলেন দু’জনে। আর বৈঠার প্রচন্ড বাড়িতে কুমিরও কাবু। পানিতে থেকে কুমির শিকারের সেই ভয়ঙ্কর কাহিনী শোনালেন সুন্দরবনের মারকুটে বাওয়ালি। কুমিরের কামড়ে পিঠের ঘা শুকোতে বিস্তর সময় লাগে। চিকিৎসার অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়।
ডিঙ্গি ভিড়ানোর জায়গাটা বনের এক চিলতে ফাঁকায়। ডিঙ্গির ঘাটই বটে। আমাদের স্পীডবোটও এখানেই ভিড়ানো। পাড় থেকে জঙ্গল মাত্র গজ দশেক দূরও হবে না। প্রায় তিন দিকেই অন্ধকার হয়ে আসা বনের জটলা। খানিক আগেও বাঘের দাবড়ানি খেয়েও আপাত নিঃশঙ্ক চিত্তে কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন বাপ-বেটা। সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিদের কর্মকান্ডের ধরনটাই ওরকমের। বাঘ-কুমির-কামটের শিকার হওয়াটাও যেন নেহাৎ একটা মামুলি ব্যাপার। এটাই সুন্দরবন। জঙ্গল-জানোয়ার-মানুষের এক বিচিত্র সমীকরণ। ভেড়ানো স্পীডবোটসহ ড্রাইভার রয়ে গেলেন ওদের সাথেই।
ফরেষ্ট গার্ডের পিছু নিয়ে দুপাশের গা-ঘেঁষা গাছ-গাছালির ফাঁক গলে এগোলাম ফিকে আঁধারে ঢাকা সরু পায়ে চলা বনপথ ধরে। খানিকটা যেতেই বন ফাঁকা হয়ে এলো। একটা বিশাল ঘেসো মাঠের প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। আমাদের একটু ডানে বড়ো মাঠটার মাঝখানটা ধরে ফুট তিনেক উঁচু সরু একটা জাঙ্গাল চলে গেছে দূরে-পুবের ঘনায়মান অন্ধকারে। জাঙ্গালটার গায়ে হালকা ঝোপঝাড়। বেশ খানিকটা দূরে সিকি মাইলটাক হতে পারে- ফিকে অন্ধকারে দেখলাম একটা মানুষ একাকী একটা ঘাসের বোঝা মাথায় করে আমাদের বাঁ দিকে কচি খালের পাড়ের জঙ্গলের জটলার দিকে যাচ্ছে। নিশ্চয় খালে ডিঙ্গি ভিড়ানো। খানিকটা গলা উঁচিয়ে ফরেষ্ট গার্ড ডাকতেই লোকটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ফের চলতে লাগলো নিজের গন্তব্যে। বাওয়ালিরাতো কিছু সময় আগে ও দিকেই বাঘটাকে দেখে এসেছেন শেষমেশ। সদ্য শিকার হারানো ক্ষুধার্ত জানোয়ার, আর সেদিকেই যাচ্ছে মানুষটা। সুন্দরবনের খুঁটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষদের জীবনের বাস্তবতাটা এমনি কঠিন বটে।
আমরা ডানে ঘুরে ডানপাশের জঙ্গল ঘেঁষে খানিকটা এগিয়ে যেতেই বিশ-পঁচিশ গজটাক দূরে দেখলাম হরিণের এক বিশাল গণসমাবেশ। যেন কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের শুরুতে প্রধান বক্তা কেবল গলা খাঁকারি দিয়েছেন মাইকের সামনে, বক্তৃতা শুরু হল বলে। শ্রোতাদের পিনড্রপ সাইলেন্স। মালি (মাদি), শিঙ্গাল, গেদা, বুড়ো, সবাই গা ঘেঁষা ঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে এক সাথে রাতটা কাটাবে বলে। শিংয়ের ছড়ানো ছিটানো ডালপালা নজর করে দেখে মালি আর শিঙ্গালের তফাল্টা মালুম হচ্ছিলো। গায়ের মনোহর পোষাকের রং কিংবা ছিট না দেখতে পেলেও জানা ছিলো এরা সবাই সুন্দরবনের অলংকার চিত্রল হরিণ।
আঁধার একটু গাঢ় হতে টর্চের আলো ফেললাম। আলোর প্রতিফলনে ঝিক-মিকিয়ে ওঠে হাজার চোখের লহর। এখানে এই গা ঘেঁষা-ঘেঁষি ভিড়ে মাঝে মধ্যে খটাখট শব্দ জানান দিচ্ছিলো শিঙ্গালদের ঘরোয়া বিবাদ মিটানোর প্রয়াস। ওই জঙ্গলে কতো হরিণ হবে? পাঁচশো? সাতশো? না আরো বেশি? তা কে যাবে গুনে দেখতে? টর্চের আলো যতোদূর যাচ্ছে, কেবল আলোর প্রতিফলন। বাঘের ভয়ঙ্কর থাবার নিচে জীবন কাটানো তৃণভোজী প্রাণীদের আপাত নিরাপত্তার প্রয়োজনে একাট্টা হয়ে রাত কাটানোর সম্মিলিত গণ-উদ্যোগ। সহসা বনে এসেই এমন হরিণের বিশাল ঝাঁক দেখা আজকাল খুব একটা ঘটে না। উদ্যোগী ফরেষ্ট গার্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে কটকার ঘাটে নামিয়ে দিয়ে তারার মলিন আলোয় নদীপথের উজানে ছুটলাম এক নিরুদ্দিষ্ট লঞ্চের সন্ধানে।
৩. দুপুর গুড়িয়ে বিকাল তখন। মুরগী খোঁজার উসিলায় সুন্দরবনের দাপুটে ডিএফও আলী আকবর ভূঁইয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার বড়োসড়ো জলশকট ‘বনকন্যা’ ছেড়ে স্থানীয় এক জেলের ডিঙ্গিতে চড়লাম। বুড়ি গোয়ালিনীর চুনার গাঙ্গ থেকে ভাঁটার টানে খোলপেটুয়ার প্রশস্ত বুকে পড়লাম বন গবেষনা প্রতিষ্ঠান-এফআরআইয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ হাসান সাহেব আর আমি। হাসান সাহেব আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেলজিয়ামে ডক্টরেট ও তারপর পোষ্ট ডক্টরেটও করেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এফআরআইয়ের পরিচালকের পদ থেকে অবসর নেন। গত আঠারো সালের ডিসেম্বর পঁচিশের রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চির বিদায় নিলেন বন্ধুবর পরম সাহসী অনুসন্ধিৎসু গবেষক ড. হাসান। পরম করুণাময়ের আশ্রয়ে তাঁর আত্মা চির শান্তিতে থাকুক!
বড়ো নদী খোলপেটুয়া ধরে কিছুটা ভাঁটিতে নেমে ডান তীরের একটা সরু বাঁকা খালে ঢুকলাম। খালে ঢুকে দখিনমুখী বাঁক নিতেই বন মোরগের কটকট শব্দের সতর্ক বার্তা পেলাম। কোনো মাংসাশী জানোয়ার দেখে বৃক্ষশাখার নিরাপত্তায় চড়ে বনের তাবৎ নিরীহ বনবাসীদের জানিয়ে দিচ্ছে বিপদ বার্তা। চুলের কাঁটা বাঁকটা ঘুরে খালের দখিন পাড়ের হেঁতালের ঘন ঝাড়ের পাশ দিয়ে পশ্চিমমুখো হলাম। ভাঁটার টানে পানি কমে যাচ্ছে। ডিঙ্গির পাটাতনে দাঁড়িয়েও হেঁতাল ঝোপের আড়ালের ডাঙ্গা তেমন দেখা যাচ্ছেনা। খানিকটা এগোতেই হেঁতালের ঝাড় শেষ। দুই তিন ফুট উঁচু হুদো বা টাইগার ফার্ণের ঘন ঝোপ। তারপর উঁচু গাছ-গাছালির ঘন জঙ্গল। আমাদের ‘মেজবান’ ওদিক থেকেই এসেছেন ‘মেহমানদারি’ করতে; একটু পরই টের পেলাম।
সামনে খালের দখিন পাড়ে একটা মরা গাছের ডালে বাদামি শালিকের ঝাঁক। লোকালয়ে দেখা ভাত শালিক। আমাদের ডিঙ্গি যখন গাছটা বরাবর খাল ধরে যাচ্ছে, হঠাৎ শালিকের ঝাঁক কিচির মিচির আওয়াজ তুলে হুড়োহুড়ি করে সবকটা পাখী নিচু উড়ালে খুব দিকে গেলো লুকনো কিছু একটা জানোয়ার লক্ষ্য করে।
ডান পাড়ের ঝোপঝাড় একটু হালকা আর পাড়টা খানিকটা নিচু। অনেক দূরের বন থেকে শিঙ্গালের সতর্ক চিৎকার ভেসে এলো। ‘অ্যাঁইয়ো-অ্যাঁইয়ো’- যেন এক করুণ বিলাপের ধ্বনি। হরিণের বিপদসূচক সতর্ক আওয়াজ। উত্তরে চুনারের কাছাকাছি হবে। মোরগ, হরিণ, বানর এরা বনের চৌকিদার বটে।
কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আসা, তার হদিস নেই। এ সময়টা মোরগ-মুরগী একটু খোলামেলা জায়গা, নদী-খালের কিনারে ছোট ঝোপঝাড়ে পোক-মাকড় খুঁটে খায়। আজ তাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। যতো ভজকট লাগালো সেই অদৃশ্য ঝামেলা- যার মোকাবেলা করছে ভাত শালিকের ঝাঁক। যার আগমন বার্তা বনমোরগ খালে ঢুকতে না ঢুকতেই জানিয়ে দিয়েছিলো। এদিকে ভাঁটার টানে খালের পানি দ্রæত নেমে যাচ্ছে। সামনে খাল আরো সরু। নৌকা ঘুরাতে অসুবিধা হবে। তাই ছোকড়া মাঝিকে ডিঙ্গি ঘুরাতে বলতেই সে তাই করে। তাও ডিঙ্গির দুমাথাই খালের দুকূলের মাটি ঘষ্টে গেলো। ভাঁটায় সরু খালের পানি যখন তলানিতে, দুপাড়ের উঁচু ডাঙ্গা সুন্দরবনের জঙ্গলে খুবই বিপদজনক। শালিকের ঝাঁকটা মস্তো সরগোল তুলে দখিন পাড়ের হুদো বনে আমাদের অদেখা জানোয়ারটার পিছে লেগেছে বেচান হয়ে। মাঝে মাঝেই এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে জানোয়ারটাকে প্রায় ছোঁ মারছে। চুপিসারে শিকারে এসে এমনভাবে বেমক্কা ধরা পড়ে গিয়েও শিকারী জানোয়ার একটা শব্দও করছেনা। বেচারি চোরের মতো পশ্চিম থেকে পুবে আবার পুব থেকে পশ্চিমে যাচ্ছে আর পাখীরা লো-ফ্লাইটে তাকে অনুসরণ করছে সরবে। শালিকের উত্তেজিত ঝাঁকটা তাদের গাঢ় বাদামির সাথে উজ্জ্বল সাদা ছোপমাখা পাখা ঝাপটে তাড়া করছে শত্রুকে। অবশ্যই ওটা বাঘ। হরিণ-শূয়োরের সাথে শালিক কিংবা মোরগের কোনো বিসংবাদ নেই। কেবল মাংসাশী জানোয়ার দেখলেই ওদের যতো আতঙ্ক আর উত্তেজনা।
মোরগের প্রত্যাশায় এসেছিলাম। এখন আত্মরক্ষার তাগিদে বন্দুকের বিবি কার্টিজ বদলিয়ে এলজি লোড করেছি ইতোমধ্যে। আমার সতর্কতা দেখে বন্ধু হাসান সাহেবও মাঝির হেঁসোয়াখানা শক্ত মুঠিতে ধরে শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়ালেন ডিঙ্গির মাঝ বরাবর। যেন জবরদস্ত বাঘকেও ছাড় দেয়া যাবেনা কোনো রকম। বাঘটা নিঃসাড়ে এসে ঘাপটি মেরে বসার সুযোগ খোঁজার জন্য এসেছিলো। আমাদের কেউ ডাঙ্গায় নামলেই রাতের ডিনারটা হয়ে যায়। তারপর কিছু থাকলে কাল-পরশুর খোরাকও হয়ে যেতো। বাদ সাধে বেয়াদপ ছোটলোক শালিকের বেত্তমিজ দঙ্গল।
পানি বেজায় কমাতে হুদোবনের এমন গরমাগরম নাটকটা কমই দেখতে পেলাম। কেবল শালিকদের লো-ফ্লাইটে একবার পুবে, আবার পশ্চিমে একটা কিছু তাড়িয়ে নেয়াই কেবল দেখছিলাম। আমরা নিঃশব্দে ডিঙ্গি যতোটা সম্ভব বাঁ পাড় ঘেঁষে চললাম। হেতালের আড়ালে এসে একটু ভরোসা হলো, হেঁতালের কাঁটা ভেঙ্গে অরণ্যের মহারাজ কি নৌকায় ঝাঁপ দেবেন? শিকার হাত-ছাড়া হচ্ছে দেখে বেপরোয়া বাঘ কী করে না-করে তাওতো বলা যায় না। সাবধানের মার নেই নীতিবাক্য মাথায় রেখে, বন্দুকের বাঁট ডান কাঁধে সেঁটে নল দুটো ডানের ডাঙ্গার দিকে রেখে এক সময় খালের চুলের কাঁটা বাঁকটা পার হলাম। সামনেই খোলপেটুয়া। বড়ো নদীতে পড়তেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম এবারের মতো। শালিক পাখীরাই শিকার খোঁজা বাঘকে হতোদ্যম করে দেয়। পাখীরা ওখানে না থাকলে বা এতো মারমুখী না হলে আমাদের কেউ ডাঙ্গায় নামলে আর রক্ষা ছিলো না। পাঁচ-ছ’মনি সাক্ষাৎ যমের বিদ্যুৎ গতির আক্রমনের মুখে যদি বন্দুক চালানোও যেতো, তাও বারোবোরের শটগান দিয়ে ওই হামলা ঠেকানো যেতো কিনা সন্দেহ।
৪. সেবার যাত্রা শুরুতেই দেখা একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়। তখন বিকাল হয়ে এসেছে। ডিএফও সাহেবের লঞ্চখানা চাঁদপাইয়ের মৃগমারীর পর শেলা গাঙ্গের উত্তর প্রান্ত ছুঁয়ে উত্তর-পুব দিকের আড়োভারানী খালে সবে ঢুকেছে। আর বন জঙ্গলে এলেই আমার আদ্যিকালের নেশায় খালের দুকূলের বনেই চোখ রাখতে চেষ্টা করছিলাম। একবার ডানে একবার বাঁয়ে জলযানের ছাদে বসে। কারো আচমকা চিৎকার শুনেই বোধ হয় লঞ্চের ডান দিকে ঝুঁকে খালের প্রায় স্বচ্ছ পানির গভীরে চোখ রাখলাম। হায় খোদা, সেকী মস্তো কুমির-চৌদ্দ ফুটের কম নয়। সবজে ধূসর পিঠ। যেন কতোই না নিরীহ প্রাণী। প্রপেলারের শব্দেই ঘাঁপটি মেরে খালের তলার কাদায় গা মিশিয়ে শুয়েছিলো। তাবৎ কুমির গোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম ও হিংস্রতম প্রাণী লোনাপানির কুমির! এসচুয়ারাইন ক্রোকোডাইল।
সেদিন সন্ধ্যারাতে ধানসাগরের নিবিড় জঙ্গলে জনা দুই সাহসী ও নিরস্ত্র বনকর্মীকে অনুসরণ করে গিয়েছিলাম। বনের সরু পায়ে চলা পথে লোডেড শটগান হাতে বাঘের রাজত্বে অনুপ্রবেশকারী হয়ে সুন্দরবনের অন্ধকার রাতের ভীতিপ্রদ রোমাঞ্চ সত্য কথা বলতে কী-বেশ ভয়ে ভয়েই উপভোগ করেছিলাম। আর এটাও উপলব্ধি করলাম, আমার মতো সুন্দরবন-নবিশের হাতে বন্দুক বা রাইফেল যাই থাকুক না কেন, এই শার্দুল অধ্যুষিত বনে রাতে চলাফেরা করাটা উপভোগ্যতো নয়ই, নিরাপদও নয়।
৫. এ ঘটনার অনেক দিন পর খুলনা রেঞ্জের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অর্পনগাছিয়া বা আড়পাঙ্গাসিয়া আর মালঞ্চের দশ-বারো কিলোমিটার প্রশস্ত মোহনার পুবপাশের অভয়ারণ্যের সমুদ্র উপকূলে এক চাঁদের রাতে এক অপূর্ব নিভৃত নির্জনে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছু সময়। বন্ধু হাসান সাহেবকে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেশ রাত পর্যন্ত চাঁদনী রাতের এন্তার হাওয়া খেয়েছিলাম সমুদ্রের কাছে সৈকতের বালুচরে বসে। সময় আপন মনে সুনসান বয়ে যাচ্ছিলো নিঃশব্দ নীরবে মহা-অরণ্যের নিভৃত গহনে। আর অলস রাতের নিষুপ্তি ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো সাত সাগর ডিঙ্গানো দমকা মাতাল হাওয়ায় আর সাগরের শ্রান্তিবিহীন তরঙ্গ ভঙ্গে। দূরে, দক্ষিণ-পশ্চিমে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে, পতœী দ্বীপ যেন শুচিবায়ুগ্রস্তা এক দ্বিজকন্যার মতো বাংলাদেশের যাবতীয় অশৌচ স্পর্শ এড়িয়ে বসে আছে এক ধোঁয়াটে-কালো ফোঁটার মতো সাগরের গাঢ় ধূসর কোলে। জঙ্গল আমাদের থেকে বিশ-ত্রিশ গজ দূরে। বনের সীমানা ঘেঁষে একটু এ্যাবড়ো থেবড়ো বালিয়াড়ির কয়েক গজ বর্ডার, তারপর ঢালু সৈকত। হাওয়া আর ঢেউ-ভাঙ্গার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো সাড়া শব্দই ছিলো না। হাঁকডাকের ব্যাপারে বাঘ বেজায় সংযত। কেবল মিলনের আগ্রহে সাথী খোঁজার জন্য ডাকাডাকি করে, আর প্রতিদ্ব›দ্বী বাঘের সাথে লড়াই করার কালে আর শিকার ধরার মুহূর্তে কোন কোন সময় অথবা খুব রেগে গেলেই তর্জন-গর্জন করে। আর হরিণ বিপদ আপদেই কেবল বিলাপ তোলে। নিঝুম চাঁদনী রাত আমাদের যেন মোহগ্রস্ত করে রাখে।
এমন মায়াবী চাঁদের রাতে অতি সতর্ক দৃষ্টিরও ভুল হতে পারে। বালিয়াড়ি আর সৈকতের ধোঁয়াটে-ধূসর বর্ণের সাথে নিজের জ্যোৎস্না মাখা ধূসর গাত্র বর্ণ মিলিয়ে নিখুঁত ক্যামাফ্লাউজের আড়ালে বিপদজনক নৈকট্যে চলে আসতে পারে সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর। রাত বাড়তেই সহসা বোধ হলো নিজেরতো বটেই, সাহসী বন্ধুটির জীবনেরও বড্ডো ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। লঞ্চে পৌঁছার পথে ধারে কাছে ঘনিয়ে আসা বনের ছায়া, মিঠা পানির জন্য খোঁড়া অগভীর কুয়োটা, যা সন্ধ্যার আগে মনে হয়েছিলো মামুলি বিষয়- এসবইতো মহাবলের শিকারের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকার সুলভ ঘাঁটি। আর আমরা কি সারাটা সন্ধ্যারাত দু’দুটো লোভনীয় টোপ হয়ে অদৃশ্য কাউকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে যাইনি? যাক, তবুও বিপদের আশঙ্কা বুঝে সতর্ক হলাম। খুব সাবধানে বন্দুক তাৎক্ষণিক গুলি ছোঁড়ার জন্য তৈরি রেখে, গাছের ছায়া ঢাকা এলাকায় এসে টর্চ জ্বেলে সামনে, ডানের জঙ্গলে, বাঁয়ে নদীর প্রায় খাড়া পাড়ে আলো ফেলে- যতোনা বাঘ দেখার আশঙ্কায়, তার চেয়ে বেশি তাকে ঘাবড়ে দেয়ার প্রয়াসে এগিয়ে গেলাম পুব থেকে এসে আড়পাঙ্গাসিয়াতে পড়া খালের দখিন পাড়ে ভিড়ানো লঞ্চের উদ্দেশে। কূয়োর কাছাকাছি হতেই বাঁয়ে নদীর খাড়া ঢালে নেমে প্রায় পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলাম, যেকোনো আচমকা হামলা এড়াতে। অবশেষে লঞ্চে পৌঁছে গেলাম নিরাপদেই। সারেং বেচারিরও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে।
৬. বছর কতোক পরের কথা। সুন্দর বনের দক্ষিণ পুবে সাগর পাড়ে টাইগার পয়েন্টে বিকাল কাটিয়ে সন্ধ্যা লগ্নে গুমোট বনের পরিবেশ ছেড়ে রেঞ্জারের লঞ্চে নিরিবিলি রাত কাটালাম। সকাল বেলা যাচ্ছি বাঁয়ে কটকা রেখে ঝাঁপা বা জাফা খালের দিকে। ঝাঁপার আগে ভাঙ্গরা নদীর উজানে কিছু বাগদা চিংড়ি কেনা হল জেলে নৌকা থেকে। ঝাঁপায় ঢুকেই ডান পাশের চরে নতুন গেওয়া বনে নেমে মাটির নমুনা জোগাড় করা হলো। লঞ্চে উঠে খেয়াল হলো ছুরিটা ফেলে এসেছি গেওয়া বনে। তখন আবার ফিরে গিয়ে সেই ঝোপালো গেওয়া বনে মামার সাক্ষাতের ঝুঁকি নিয়ে ছুরি খোঁজার উৎসাহ আর ছিলোনা।
যাচ্ছি পশ্চিমে ঝাঁপা ধরে। যথেষ্ট প্রশস্ত ভরানী খাল ঝাঁপা। পাশে বসা বন্ধু হাসান সাহেব আমাদের পরিচিত, কিংবা আমার কম পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, সাবেক সহপাঠী কিংবা ইউনিভার্সিটির টিচারদের নিয়ে মজার মজার গল্প ফাঁদেন। আমরা বসেছিলাম সারেং ঘরের সামনে পাতা একটা বেঞ্চে। আমি খালের দুকূলের বন দেখছিলাম। সুন্দরবনের নিজস্ব নিসর্গ আর বনবাসী ছাড়া আর কোনো গাল-গল্পে তখন আমার মন ছিলোনা। পিপাসার্ত চোখ মেলে একাগ্র মনোযোগে দেখে যাই। যতোবারই এ বনে গিয়েছি ওই আমার একমাত্র নেশা-বাঘ দেখবো। অথচ একবারও স্পষ্ট করে সুন্দরবনের বাঘ দেখিনি।
ব্রিটিশের উপনিবেশ কাল থেকে অদ্যকার সময়েও বন্দুক-রাইফেলের উপদ্রবে বুনোজন্তু-জানোয়ার-পাখপাখালী প্রায় নিঃশেষ। সুন্দরবনের দুই প্রজাতির হরিণ-হগডিয়ার আর বারোশিঙ্গা আর নেই। মায়া হরিণ বা বার্কিং ডিয়ার নাফি কিছু আছে, তবে আমি দেখিনি। চিতাবাঘ, বুনো মোষ নেই, দুই প্রজাতির গন্ডার-এক গড়গধারী এশীয় গন্ডার আর একটু বেঁটে জাভা গন্ডার একশো বছর আগেই নাকি খতম। এখনও কালে ভদ্রে মাটির ফুটকতোক গভীরতা থেকে খোঁড়া খুঁড়িতে-গোপালগঞ্জের ঝোঁপা মাটির বিলের আশে পাশের এলাকা থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরা পর্যন্ত এলাকায় গন্ডারের মোটাসোটা হাড়গোড়, কঙ্কাল বের হয়ে পড়ে। আরো পশ্চিমে সীমান্তের ওপাড়েও।
গত ঊনিশশো সত্তর-আশি নাগাদ সুন্দরবনে নীল কমল খালের আশপাশে হরিণের ঝাঁক দেখেছি। বিশেষ করে বিকালে। রাতে হরিণ হীরন পয়েন্টে, নীল কমল খালের পাড়ে ভিড় জমাতো বিপুল সংখ্যায়। হয়তো জন-মনুষ্যের কাছাকাছি এসে বাঘের হামলা থেকে নিরাপত্তার জন্য। মালি, শিঙ্গাল, পিচিচ, বুড়ো সব্বাই। নিজের চোখেই দেখা। এইতো সেদিন মাত্র, ১৯৫০ এর দশকে সাংবাদিক ও শিকারী তাহাওয়ার আলী খান সন্ধ্যা রাতে একটা মানুষ খেকো বাঘিনী মেরেছিলেন নীলকমল খালের পাড়ে (Tahawer Ali Khan, Man Eaters of Sundarbans)। ঘটনা চক্রে ১৯৭৯ সালে আমিও-অবশ্যই একা নই সাথে লোকজন ছিলো- একটা প্রকান্ত রয়্যাাল বেঙ্গল খেদিয়ে বেড়িয়েছিলাম এই নীলকমলের বন ও খালে, সেও অজ্ঞাতসারে। অথচ ১৯৯৭ এর ডিসেম্বরে নীল কমলে কেবল রাতে মালি হরিণ দেখেছি। একটা শিঙ্গালও দেখিনি। শিকারীরা সাধারণত শিঙ্গাল শিকারেই আগ্রহী বেশি। বাঘের পাগমার্ক কমই দেখেছি এসময়। আমরা সেই গল্পের ধনী কৃষকের বোকা ছাওয়ালদের মতোই। বাপ-দাদার সহায় সম্পদ সবকিছু বেচে-থুয়ে খেয়েছি। এখন হাঁড়িতে ছুঁচোর কেত্তন!
ঝাঁপা খালে ফেরা যাক! সময় তখন আন্দাজ সকাল নটা-সাড়ে নটা। একটা বাঁকের বাঁ তীরের ‘ঠোটে’ একচিলতে বালি জমেছে। সেই বালির সৈকতে দু’দুটো বুনো শূয়োর বসেছিলো সকালের রোদ খেতে। আকাশ চিত্র বিশ্লেষণের যন্ত্র স্টেরিওস্কোপের আলাদা জোড়া বাইনোকুলারের একটা নিয়ে এসেছিলাম। ‘মনোকুলার’টা চোখে লাগিয়ে দেখছি মাঝে-মধ্যে। একটু এগোতেই বুঝতে পারলাম ওদুটো শূয়োর নয়-দু’দুটো হরিণ। আমাদের লঞ্চ আরো কাছে চলে আসতেই হরিণ দুটো সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। লঞ্চের সারেং সাহেবকে ইশারা দিতেই খালের বাঁ তীরের দিকে লঞ্চ নিতে শুরু করেন। গতিক সুবিধার নয় টের পেয়ে হরিণ যুগল বনের দিকে ফিরে দৌড়াতে শুরু করে। আর ধাবমান প্রাণী দুটোর ঝোলা পেটের এপাশ-ওপাশ দুলুনি দেখে আমি বলে উঠলাম, ‘বাঘ’। হরিণের পেট এতো ঝুলে থাকে না। দৌড়ালে এমন করে দোলেও না। ততোক্ষণে লম্বা লেজের এ পাশ-ওপাশ দোলাও বাঘের দৌড়ের সাথে চোখে পড়লো। এক জোড়া হুঁশিয়ার বাঘ দুলকি চালে দৌড়ে বনের আড়ালে চলে গেলো। সেবারই আমার সুন্দরবনের বাঘ এমন পষ্টৌ করে দেখা।
লঞ্চ ডান দিকে ঘুরে কাগাবগা খালে ঢুকেছে। বেলা বড়জোড় দশটা। কিছুটা এগিয়ে যেতেই খালের ডান তীরে দেখলাম একটা বড়োসড়ো ধলবক। সম্ভবত সুন্দরবনের ‘জাঠুয়া’ বক। পানি থেকে খানিকটা ওপরে। মনোযোগ পানির দিকেই। কাগাবগার একটা বাঁকে এসে লঞ্চ বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ফের ডানে ঘুরে খালের বড়ো বাঁকে পড়লো। এখানে খালের পানির ওপর দিয়ে দৃষ্টি বেশ খানিকটা দূরে যায়। পোস্ট-ব্র্রকফাস্ট গল্প আগের রেশ ধরে চলে। আর শ্রোতার মনযোগও সুন্দরবনেই। কারো অফিসেও নয়, ভার্সিটিতেও নয়। এক সময় বেশ দূরে খালের পাড় ভেঙ্গে পানিতে পড়ে উল্টে যাওয়া একটা গোল গাছের প্রকান্ড মুথা আর ঝাঁকড়া কালো শেকড়ও দেখলাম। মনোকুলারে ভালো করে চোখ রেখে দেখতে দেখতে একটু নড়াচড়া চোখে পড়তেই বোঝা গেলো, ওটা গোল গাছের ওল্টানো মুথা নয়। ওটা একটা বড়োসড়ো ধাড়ী বুনো শূয়োর। আমার মনোযোগ ওই প্রকান্ড ধাড়ী শূয়োরের দিকেই। খালের প্রায় মাঝ বরাবর পানিতে তার পরম আরামের স্নানপর্ব দেখতেই ব্যস্ত ছিলাম।
ওদিকে গল্প চলছে আপন গতিতে। শূয়োরটা মধ্যখালের একটু ডানে আর উত্তর পাড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। খাল ওখানে পাশে একটু বেড়েছে। মার্চ-এপ্রিলের দুপুর-ঘেঁষা গরমে বেচারি গা শীতল করছে। কামট-কুমিরের পরোয়া নেই। তা থাকলে এই ঠান্ডা পানিতে অবগাহনের মজাটুকু থাকতো না। প্রাণীটা আরো একটু নড়তেই বুঝলাম ওটা একটা প্রকান্ড মাথা মাত্র। একটা কানও একটু নড়ে। কানের পেছনের কালোর মধ্যে সাদা ফুটকিটা পলকের জন্য স্পষ্ট দেখলাম। আর তাতেই সমুদয় গোলের মুথা-শূয়োর ইত্যাদির রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেলো। শূয়োর টুয়োর কিছু নয়- স্বয়ং রয়্যাল বেঙ্গলের একখানি প্রকান্ড মস্তক। আস্তে বললাম, হাসান সাব, সামনে বাঘ! বাঘের এতো সময় ধরে দেখা দূরবর্তী সাদা হাঁসের মতো কিছু একটা, তা বড়ো হতে হতে একটা মনুষ্যবাহী প্রকান্ড জলযান হয়ে গেলো। গুডু গুডু আওয়াজ তুলে এগিয়েই আসছে। বিষয়টা কী দেখার জন্য মহারাজ এবার খানিকটা ঘাড় বেঁকিয়ে সেদিকেই মনোযোগ দিলেন। কিন্তু খালের সেই জায়গা থেকে ইঞ্চিটুকুও সরলেন না। আমরা দুজন বেঞ্চের ওপরই বসেছিলাম। এবার বাঘ দেখার উত্তেজনায় দুজনেই বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে গেলাম। চরম ঔৎসুক্যে, বনের মহারাজকে ভালো করে দেখবো বলে। দ্রæত একসময় কেবল বন্দুকের রেঞ্জেই নয়-সোজা ঢিল-ছোড়া দূরত্বে এসে পড়েছি। কিন্তু মহারাজের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্যই দেখা গেলো না। বাঘ কেবল এগিয়ে আসা লঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছিলো আর কোনো নড়াচড়া নয়। ভাবখানা এই ‘এসেছো যখন বাবাজী, তোমার পথে চলে যাও, আমার গোসলে বাগড়া দিয়ো না।’
আমাদের ইশারায় সারেং গতি কমিয়ে লঞ্চের মাথা ঘোরালেন সামান্য ডানে। লঞ্চ একটু এগিয়ে যেতেই এবার মহারাজের চৈতন্য হলো- না: বেটাদের মতলব সুবিধার বোধ হচ্ছে না। বেয়াদপের হদ্দ মানুষগুলো অতোবড়ো জিনিসটা গায়ের ওপরই তুলে দেবে নাকি? সত্যি বটে, লঞ্চ ততোক্ষনে বাঘের প্রায় পনেরো-বিশ হাত দূরত্বে চলে এসেছে।
সাইমোটা গর্দানখানা তীরের দিকে ঘুরিয়ে- তাও খুব একটা তাড়াহুড়ো করে নয়- লাফ দেয়ার উদ্যোগ নিলো বাঘ। তখনো মনোকুলারের মধ্য দিয়েই দেখছিলাম। কালো ডোরা কাটা আগুনে বর্ণের ঝকঝকে দেহখানা একটা বিশাল বেরেলের মতো পানি থেকে উঠছেতো উঠছেই। সে উত্থানের যেন শেষ নেই। তারপর যেন বিদ্যুৎ ঝলকের মতো উড়ে গিয়ে ডাঙ্গার কাছেই বাঘ অল্প পানিতে পড়ে সুন্দরবনের প্রেম কাদার গভীরে থাবা দু’খানা সেঁধিয়ে দিলো। আমি ভাবলাম বাঘ বাবাজীর কেরামতি দেখবো এবার। ওই ভীষন আঠালো প্রেম ঘন নিবিড় বন্ধন কীমতে ছিন্ন করে শার্দুল বাবাজী ডাঙ্গায় ওঠেন, দেখা যাবে। সুন্দরবনের প্রেম কাদার আকর্ষণী ক্ষমতার ভয়াবহতা তখনো আমার স্মৃতিতে তরতাজা ছিলো। বনের জোয়ারের পানিতে ভেজা কাদাটে ডাঙ্গায় চলা-ফেরার সুবিধা হবে বিবেচনায় সেবার হাসান সাহেব আনকোরা নতুন একজোড়া গামবুট সাথে এনেছিলেন। ডাঙ্গায় সদ্য ভিড়ানো লঞ্চ থেকে নামার জন্য কাঠের প্ল্যাংকটা নামানোর অপেক্ষা না করেই আমার বারণ সত্বেও সবুট লাফিয়ে নামতে গেলেন হয়তো বুটের কার্যকারীতা টেস্ট করার জন্যই। নামতেই কপাৎ করে তীর সংলগ্ন কাদার গভীরে বুট সহ হাঁটু অবধি দেবে গেলেন। তিনি আরতো উঠতে পারছেন না। নড়াচড়া করাও সম্ভব হচ্ছে না। পিয়ন মাওলা আগেই ডাঙ্গায় নেমেছিলো লাফ দিয়ে। তার আপ্রাণ চেষ্টায় শত টানাটানি করেও সাহেবকে নড়াতেই পারলো না মাওলা। ভাগ্যিস অমন প্রচন্ড টানা হ্যাঁচড়ায় সাহেবের হাত ছিঁড়ে আসেনি। আমার নামতে যাওয়ার আগেই রিইনফোর্সমেন্ট এসে গেলো। এক তাগড়া জোয়ান খালাসী লাফিয়ে শুকনো ডাঙ্গায় নেমে নদীর ঢালুতে গিয়ে মাওলার সাথে যোগ দেয়। তাদের যৌথ টাগ-অব-ওয়ারে হাসান সাহেব কাঁদা থেকে মুক্ত হলেন। কিন্তু গামবুট জোড়া রয়েই গেলো কাদার গভীরে। কাপড় গুটিয়ে কাদায় নেমে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে পেতে বুট দুখানাই টেনে তোলে মাওলা। ফের ডাঙ্গায় নামতে হাসান সাহেব আর বুট পড়লেন না। সেদিন নগ্ন পদেই গেলেন বনে। তারপর তাকে সুন্দরবনে আর কখনোই গামবুট পড়ে নামতে দেখিনি।
আমাদের শার্দুল বাবাজীর এহেন প্রেম কাদার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু অবাক কান্ড! আমাকে কোনো মজা দেখার পলক মাত্র সুযোগ না দিয়েই- ওই গভীর কাদা-টাদা যেন কিছুই নয়- অক্লেশে সামনের থাবা দুটো কাদা থেকে বের করে আরেকটা ছোট লাফে বাঘ ডাঙ্গায়। খালের সামান্য ঢালে গেলপাতার ছোটো ঝোপের পাশে। তবে তার মধ্যে মোটেই পালানোর তাগিদ ছিলো না। সেই অদম্য ঔৎসুক্য নিয়ে এই অদ্ভুত জলযান আর তাতে আশ্রিত দুবলা মানুষগুলোর দিকেই তার অখন্ড মনোযোগ। এই দেখাদেখির উৎসাহ যেন আমাদের চেয়ে বাঘের একরত্তি পরিমানও কম ছিলোনা। ভাবখানা এমনি ছিলো যেন আমাদের কেউ ডাঙ্গায় নামলেই করমর্দনের জন্য কাদা মুছে ডান থাবাটা বাড়িয়ে দিয়ে বাঘ বাবাজী বলতো, হাঁউম, কেমন আছো? কোমরটা একটু বাঁকিয়ে ঘাড়খানা ডান দিকে ঘুরিয়েপ্র্রকান্ড মাথাটা একটু কাৎ করে আমাদের দেখছিলো গভীর কৌতূহলে। দীঘল লেজটা ইষৎ বাঁকিয়ে। বাড়তি কোনো চাঞ্চল্যই দেখলাম না তার মধ্যে, কোনো অহেতুক সতর্কতা, বিরক্তি বা ভয়- কোনোটাই ছিলো না, নিঃসাড়ে দেখে যাচ্ছিলো আমাদের যেন নিছক কৌতুহলেই। সহসা গুলির প্রচন্ড বিস্ফোরণ। পলকের মধ্যে বাঘও লেজ তুলে এক লাফে উধাও ডাঙ্গার নিবিড় বনের আবডালে। চমক ভাঙ্গতেই খোঁজ পড়ে, কে গুলি করেছে? কোত্থেকে করেছে? আমি ভাবলাম বেঞ্চের ওপর রাখা গুলিভরা আমার বন্দুক থেকেই বুঝি মিস ফায়ার হয়েছে। ব্রীচ ভেঙ্গে কার্তুজ দেখলাম দুটো নলেই অক্ষত, আনাম। তাহলে? ফরেষ্ট গার্ড দুজনকে ডাকা হলো লঞ্চের ছাদে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। নিচের ডেকে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো জটলা থেকে আমাদের দুজন গার্ডের মধ্যে একজন গুলি করেছেন তার সার্ভিস রাইফেল থেকে। এতো কাছে থেকে বাঘ দেখার উত্তেজনা সামলাতে না পেরে, নাকি সুন্দরবনের জলজ্যান্ত প্রকান্ড একটা বাঘ শিকারের এমন সহজ একটা মওকা মিস করতে অনীহার কারণেই গুলি করে বসেছেন বেঅকুফ লোকটা। অথবা ওপর থেকে আমাদের কারো গুলি করতে না দেখে অধৈর্য্য হয়ে কিংবা এই ভেবে যে, বাঘের ভয়ে বেজায় আতঙ্কিত হয়ে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বেচান হয়ে পড়েছি। তাই ওই ভয়ঙ্কর বাঘের আন্ড হামলা থেকে আমাদের রক্ষার তাগিদেও এমনটি করতে পারেন। তবে বাঘ বাবাজীর শা-কপাল! মাত্র পনেরো বিশ হাতের ফারাকে ইয়া দশাসই টার্গেটে প্রায় একই লেভেল থেকে ছোঁড়া গুলিও মিস! লজ্জায় থ্রি নট থ্রি বুলেট কাদায় সেঁধিয়ে মুখ লুকিয়েছে! তবে বাঘ বাবাজীর মা-বাপের জবর দোয়া ছিলো!
আমাদের ক্ষয়িষ্ণু বনজ সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখা, আর বনের বিরল প্রাণীকুলকে হত্যা করবার সুযোগে কেবলই নিধন না করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই এদের বাঁচিয়ে রাখা, ওদের জীবনের অনুকূল পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখে ওদের বাঁচতে দেয়া এদেশের প্রতিটি মানুষের নাগরিক দায়িত্ব। কিন্তু এই জ্ঞানটার, দায়িত্ব বোধটার নিদারুন অভাব আমাদের সমাজে, আমাদের দেশে। অন্ততপক্ষে যাঁরা এই প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে কিছুটা ধারনা রাখেন, বনের ও বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে নাগরিক দায়-দায়িত্বের কথা ভাবেন-তাঁদের একটা বড়ো কর্তব্য ছিলো- যারা এসব নিয়ে ভাবেন না, বা গ্রাহ্য করেন না- তাদের মধ্যে এই দায়িত্ববোধটা জাগিয়ে তোলা, বন ও বন্যপ্রানী রক্ষার একটা শুভ সুযোগ সৃষ্টি করা। আমরা তা করিনি। করছিওনা। হয়তো সব প্রাকৃতিক সম্পদ নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত তা করবার তাগিদও বোধ করবো না। এটাই বোধ হয় আমাদের সর্বগ্রাসী জাতীয় ভবিতব্য। আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা কি আমরা জানি? তখন বেলা এগারোটা। এই অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র একটা সকালে তিন তিনটা জলজ্যান্ত রয়্যানল বেঙ্গল দর্শন নেহাৎ একটা মামুলি বিষয় নহে, বাহে!
৭. সেদিন সকাল নাগাদ আঠারো নম্বর কম্পার্টমেন্ট বাঁয়ে রেখে আমরা বনের উজানে যেতে একটা ছোটো মরানী খালের মুখে দেখলাম পানিতে পোঁতা একটা ভাঙ্গা ডালের ডগায় ন্যাকড়া মতো এক টুকরা কাপড় ঝুলছে তাবৎ দুনিয়ার বিষাদ নিয়ে। সুন্দরবনের এক অতিশয় নিভৃত নিবিড় অরণ্য কোলে এক ক্ষুধার্ত বাঘের ভয়াল থাবার কবলে পড়ে এক হতদরিদ্র মানুষের প্রাণ হারানোর মতো এক নিদারুন নির্মম ঘটনার শোকার্ত সাক্ষী!
নালাটির পাশেই ডাঙ্গার কোলে লঞ্চ ভিড়িয়ে নামলাম। জায়গাটা কিছুটা ফাঁকা, নিবিড় আঁধারপনা অরণ্য খানিকটা দূরে একটা কেমন যেন মারমুখো অমঙ্গলের আবহ নিয়ে দাঁড়িয়ে। খুব কাছের ঝোপঝাড় বলতে গজ বিশেক দূরে ডান দিকে কটা বেঁটেপনা হেঁতালের ঝোপ কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা। একটা নরখাদক বাঘের পক্ষে অতর্কিত হামলার সুযোগ নিতে গা ঢাকা দিয়ে ওই ঝোপকটা পর্যন্তই এগোনো সম্ভব। আমরা আর না এগিয়ে কাছের একটা জায়গা থেকে মাটির নমুনা যোগাড় করি। মাটি সংগ্রহের প্রায় সবটা সময় হেঁতালের ঝোপগুলোর দিকে সতর্ক নজর ছিলো। আমরাতো তো আর সুন্দরবনের বনবিবির বাহনটিকে নিজেদের রক্ত মাংসের দেহখানা ভেট দিতে অতোশতো মাইল ডিঙ্গিয়ে আসিনি!
এই থম-মেরে থাকা গুমোট বনের সকালটাও কেমন যেন আধো অন্ধকার-নিরানন্দ-বিষাদময়। এই নিবিড় প্রায় অন্ধকার বনের কোন কোলে কবে, কখন ওই হতভাগ্য মানুষটাকে হত্যা করেছে নরখাদক বাঘটা- কোথায় তার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাপ্লুত লাশটা নিয়ে ভোগে লাগিয়েছে-কে জানে। উত্তরের মানষালয়ে কোন গাঁয়ের নিভৃত পর্ণকুটিরে নিহতের অসহায় বিধবা, আর এতিম ছেলে-মেয়ে, কিংবা সদ্য সন্তানহারা কোনো এক বিধবা বৃদ্ধামাতা শোকে ভাঙ্গা বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন-কোথায় কে জানে! আঠারো নম্বর কম্পার্টমেন্টের বিষন্ন কোল পেছনে রেখে আমরা চললাম আরণ্যক নদীটির আরো উজানে।
(বি.দ্র. লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সতীর্থ সম্মিলন ১৯৫৮-১৯৬২ এর স্মরণিকা ঢাকা, আগষ্ট-২০১৯ থেকে সংগৃহীত)

 

সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটি শেয়ার করুন

সুন্দরবনের দিবানিশি

প্রকাশের সময় : ০১:৫০:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫

সতীর্থ শ.ম. শহীদ (মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ)

১. দুনিয়ার তাবৎ কটাল পললভূমির বাদাবনের মধ্যে এক অনন্য অপরূপ নিভৃত অরণ্য এই সুন্দরবন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল হতে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ-পুব উপকূল অবধি বিস্তৃত এই বন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট। সমস্ত সুন্দরবনের দুই তৃতীয়াংশ, ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার, বাংলাদেশে। নিত্য দু’বেলা জোয়ারের পানিতে ডাঙ্গার অনেকটুকুই ডুবে যায়। আর বর্ষাকালে ভরা কটালে প্রায় সমস্ত বনই প্লাবিত হয়। আর এতো পানি- বনের ৩১ ভাগই নদী, খাঁড়ি আর খাল-অথচ এর এক আঁজলাও পান যোগ্য নয়। এসব নদী, খাঁড়ি, নালার সবকটিতেই দক্ষিণ সমুদ্রের লোনা পানির অবাধ সমাগম। বনের পশ্চিম এলাকার পানি তীব্র লোনা, পুবে কম। জোয়ার-ভাঁটার দাপট, মাটি ও পানির লবণাক্ততা, আর উষ্ণ আর্দ্র মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এই ভাঁটি এলাকার গাঙ্গেয় দ্বীপাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে এক আশ্চর্য বাদাবন বা ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট। সুন্দরী, গেওয়া, পশুরের উর্দ্ধমুখী শ্বাসমূল বা শূলো আর কাঁকড়া, গরান, খালসীর বাঁকানো ঝাঁকড়া শেকড়ের জটলা বনভূমিকে করেছে দুর্গম। ডাঙ্গায় আগুনে বর্ণের মসৃণ গাত্রে, কালো ডোরাদার রাজকীয় বাংলার বাঘ, অপূর্ব সুন্দর মায়াবী চিত্রল হরিণ, ডাঙ্গা আর বৃক্ষ পল্লবে আইরাজ (অহিরাজ) বা শঙ্খচূড়, গোখরা, কেউটে, কালাজ, চন্দ্রবোড়া আর ময়াল আর নদী-নালা, খাঁড়িতে কামট-হাঙ্গর-কুমির এই সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, গরান আর হেঁতালের দুর্গম বিশাল বাদাবনকে করেছে মনোহর, ভয়ঙ্কর, রোমাঞ্চকর আর রহস্যময়।
দুনিয়ার প্রায় সবকটি ম্যানগ্রোভ জঙ্গল দেখার পর পঁয়ষট্টির পৌঢ়ত্বে এসে সুন্দরবন দেখে হতবাক হয়ে যান ম্যানগ্রোভ বন আর মধু বিশারদ নেদারল্যান্ডের জিনি ডি বিয়ার। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ফরেষ্ট রিসার্চের নির্বাহী প্রধান আর ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন ফর ন্যাচারের (IUCN) নেদারল্যান্ড শাখার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জিনি ডি বিয়ার। সুদীর্ঘ কর্মজীবনের শেষ লগ্নে এসে সুন্দরবন দেখে ধরা গলায় বললেন, ‘অসাধারন সুন্দর! এই বনে না এলে আমার এতো বছরের জীবনের সব জ্ঞান তুচ্ছ হয়ে যেত।’
বাংলাদেশের অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ এই সুন্দরবন দেখে মধু আহরণ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নসহ সুন্দরবন সম্পর্কে ডি বিয়ার তাঁর পর্যবেক্ষণ, পরামর্শ রেখে যাবেন। তবে এসবের বাস্তবায়ন কতোটুকু হবে তা কে জানে? (ইফতেখার মাহমুদ: ‘স্বপ্ন যাঁর মধুর দুনিয়া’। সুন্দরবনের ইতিহাস-২, ২০০৭। সম্পা, রাজিব আহমেদ, গতিধারা, পৃ: ৪০৭, ৪০৮)।
নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত লক্ষœণ সেরেস্তা জং বাহাদুর ঝাঁপা আর কাগাবগা খালের সঙ্গমের বনে হরিণের ঝাঁক আর পাখ-পাখালীর আরণ্যক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গভীর আবেগে বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর বহু দেশ দেখেছি, আমাদের নেপালেও প্রচুর বন জঙ্গল পাহাড় রয়েছে। যেখানে আমি ব্যাপকভাবে ঘুরেছি। কিন্তু এমন স্বর্গীয় দৃশ্য জীবনে আমি কখনো দেখিনি। সত্য বলতে কী সুন্দরবনের কোনো তুলনা নেই। আমি আমার হিজ ম্যাজেষ্টি রাজা মহেন্দ্রকে এ সুন্দরবন দেখার জন্য অবশ্যই অনুরোধ জানাবো।’ পরবর্তী কালে ১৯৬৭ সালে তারই প্রচেষ্টায় নেপালের মহারাজা মহেন্দ্র সপরিবারে সুন্দরবন ভ্রমণে এসেছিলেন। পর্যটনের ক্ষেত্রে আজ নেপালের যে ঐতিহাসিক উন্নতি ঘটে তার সূচনা ঘটে মহারাজার সুন্দরবনের তিনকোনা দ্বীপের মনোমুগ্ধকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে। (আখতারুজ্জামান কামালঃ ‘বিপন্ন সুন্দরবনের তিনকোনা বনদ্বীপে ভ্রমণ। সুন্দরবনের ইতিহাস-২, ২০০৭। সম্পা, রাজিব আহমেদ, গতিধারা, পৃঃ ৪৫৬, ৪৫৭)।
আমাদের দেশের কোনো কোনো শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী-গুণীজনও সুন্দরবন আর এর বিপন্ন প্রাণীকুলকে হতশ্রদ্ধা করেন। তাঁরা দেশের এই অমূল্য সম্পদ বাদাবনের মাটি-পানি-প্রাণী-উদ্ভিদের অপূর্ব সম্মিলনের বা এর জটিল সামগ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে খবরাখবর কতোটুকু রাখেন আমার জানা নেই। কথায় বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। আমরা এখন সদর্পে নেমেছি তাৎক্ষণিক নগদ লাভের উন্মাদনায় প্রকৃতির এই অতুলনীয় সম্পদ সুন্দরবনকে উচ্ছেদ করতে। বনের ক্ষতিকর দূরত্বের মধ্যে দূষিত বর্জ্য নিঃসারক কলকারখানা বসাচ্ছি। সুন্দরবনের মাটি, নির্মল বায়ু আর বনের শোণিত প্রবাহতুল্য নদী-নালার পানি দূষিত করতে উঠেপড়ে লেগেছি। বনের গাছপালা, বিপন্ন দুষ্প্রাপ্য পশুপাখী, জলজ সম্পদ ধ্বংসের হালখাতা খুলেছি দৃশ্যত নগদ প্রাপ্তির মোহে, আর অন্তরীক্ষে কাদের স্বার্থে, কাদের ইন্ধনে, কে জানে?
সুন্দরবনের বাওয়ালি, জেলে, মৌয়াল, জোংড়াখুটা আর বনরক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে, তাদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের বিষয়ে সুলেখক হুমায়ুন খান সুন্দরবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বাস্তবধর্মী পরামর্শ রেখেছিলেন বন বিভাগ তথা সরকারের উদ্দেশ্যে, তার তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ ‘সুন্দরী সুন্দরবন’-এ। (হুমায়ুন খান: ‘সুন্দরী সুন্দরবন’। সুন্দরবনের ইতিহাস-১, ২০০৭। সম্পা, রাজি আহমেদ, গতিধারা, পৃঃ ৫৪৭, ৫৪৮)। এসব সুপারিশ পরামর্শ এতদসম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, ডিপার্টমেন্টের নীতি-নির্ধারকদের সক্রিয় বিবেচনায় এনে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক।
২. সেদিন সারাটা বিকাল কটকায় একটি মাছিও চোখে পড়েনি। তামাম বন যেন খালি। বাঘতো দূরের কথা, একটা হরিণও যদি চোখে পড়তো। লুকোচুরিতে বাঘ ঘাগুমাল। তার প্রয়োজনে দেখা দিতেও পারে। তবে শিকারতো সে চুপিসারেই সারে। নেহাৎ আবশ্যিক না হলে সে হই হুল্লোড়ের মধ্যে নেই। বাঘ দেখা ভাগ্যের কথা। মানে নিজে একশোভাগ নিরাপদে থেকে দেখা আরকি। নতুবা না দেখাই মঙ্গল। কথায় বলেনা, ‘বাঘের দেখা আর সাপের লেখা!’
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পাট সারা সেই কখন। তারপর সমুদ্রের স্বাস্থ্যপ্রদ লোনা হাওয়াও খাওয়া হল খানিকটা। এবার গা তোলার সময়। কটকা থেকে বের হচ্ছিলাম দলে বলে। কোথাও হরিণ দেখলাম না সেবার। একটা মুরগী কী কাক পক্ষীও নয়। অথচ স্থানীয় বনরক্ষীরা বলছেন কটকার হরিণ নাকি লোকজনের হাতে ধরা ভাঙ্গা ডাল থেকেও কেওড়া পাতা খেতে চলে আসে। আর বাংলোটার মাচানের নিচ পর্যন্ত নাকি মামাও ভিজিট করেন রাত বিরাতে। বাংলোর মাচানের নিচে অল্পস্বল্প ভিজে মাটিতে হরিণের খোঁচ দেখেছি বিস্তর। বাঘের পাগমার্ক বা পায়ের ছাপ চোখে পড়েনি।
সে দিন হরিণ দেখতে না পাওয়াতে আমার আফসোস দেখে এক তরুণ ফরেষ্ট গার্ড দারুণ এক সল্লা দিলেন। ঘাট ছাড়তে একপা বাড়ানো লঞ্চটাতে তখুনি না চড়ে তার সাথে স্পীডবোটে করে কটকার উল্টো দিকে কচি খালের পাড়ে হরিণের খোঁজে যেতে। হরিণ দেখা হলে স্পীডবোটে জোর কদমে কটকা খালের উজানে গিয়ে চলন্ত লঞ্চ ধরা যাবে। তথাস্তু! সঙ্গীদের খবরটা দিয়ে বন্দুক আর তিন সেলের টর্চটা নিয়ে স্পীডবোটে চড়লাম। সামান্য উজানে গিয়ে ডানে মোড় নিয়ে কচিখালের দক্ষিণ পাড়ে উঠলাম দু’জনে।
ডাঙ্গায় উঠতেই দেখা হল বাপ-বেটা দুই বাওয়ালির সঙ্গে। বাপ মাঝ বয়েসী, ছেলেটা কিশোর। তারা সদ্য কেটে আনা কাঠ গোছাতে ব্যস্ত। গাটাও ধুয়ে নিচ্ছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। কনে দেখা অন্ধকার। বড়ো বাওয়ালির সাথে কথা হলো।
বাপ-বেটা বাওয়ালি দু’জন পুবে কচিখালের গভীরে গিয়ে কাঠ কেটে কটকার দিকে আসছিলেন। বড়ো কাঠুরিয়ার জবানে- শয়তানটা খালের দক্ষিন পাড় ধরে ডিঙ্গির পিছু নেয়। তারাও খালের ডানপাড় ঘেঁষে ডিঙ্গি জোরে চালিয়ে দূরত্ব বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু শয়তানটা নাছোড়বান্দা। শিকার একটা ধরবেই। কচিখালের পশ্চিমে কটকার বড়ো খালের কাছাকাছি ডিঙ্গি পৌঁছলে বাঘ গা ঢাকা দেয়। বড়ো বাওয়ালিকে শঙ্কিত মনে জিজ্ঞেস করলাম, সদ্য বাঘের তাড়া খেয়ে বড়ো খালের মুখে এসে বাঘের ধাওয়া করা পাড়েই এই ভর সন্ধ্যায় কাঠ গোছানো, গা-ধোয়ার কাজগুলো ঝুঁকিজনক হয়ে যাচ্ছে না? বাওয়ালি তেমন একটা গা করলেন না, উল্টো আরেকখানা গল্প শোনালেন।
ভাইয়ের সাথে ডিঙ্গি বাইতে গিয়ে সুন্দরবনের খালে নেমে ডিঙ্গির এক পাশের ফুটো মারতে গোঁজ দিচ্ছিলেন নিজেই। ভাই নৌকার ভেতরটা দেখছিলেন। আচমকা পিঠের বাঁ পাশটা কামড়ে ধরে একটা কুমির, হেঁচকা টানটা দেবার আগেই বাওয়ালি ডিঙ্গির কিনার জাপটে ধরে ফেলেন। আর ভাইকে বলেন দড়ি ফেলে কুমিরকে আটকাতে। লড়াইয়ের এক ফাঁকে কুমিরের গা গলিয়ে মজবুত দড়ির বাঁধনে কুমিরকে আটকে ফেলেন দু’জনে। আর বৈঠার প্রচন্ড বাড়িতে কুমিরও কাবু। পানিতে থেকে কুমির শিকারের সেই ভয়ঙ্কর কাহিনী শোনালেন সুন্দরবনের মারকুটে বাওয়ালি। কুমিরের কামড়ে পিঠের ঘা শুকোতে বিস্তর সময় লাগে। চিকিৎসার অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়।
ডিঙ্গি ভিড়ানোর জায়গাটা বনের এক চিলতে ফাঁকায়। ডিঙ্গির ঘাটই বটে। আমাদের স্পীডবোটও এখানেই ভিড়ানো। পাড় থেকে জঙ্গল মাত্র গজ দশেক দূরও হবে না। প্রায় তিন দিকেই অন্ধকার হয়ে আসা বনের জটলা। খানিক আগেও বাঘের দাবড়ানি খেয়েও আপাত নিঃশঙ্ক চিত্তে কাজ গুছিয়ে নিচ্ছেন বাপ-বেটা। সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালিদের কর্মকান্ডের ধরনটাই ওরকমের। বাঘ-কুমির-কামটের শিকার হওয়াটাও যেন নেহাৎ একটা মামুলি ব্যাপার। এটাই সুন্দরবন। জঙ্গল-জানোয়ার-মানুষের এক বিচিত্র সমীকরণ। ভেড়ানো স্পীডবোটসহ ড্রাইভার রয়ে গেলেন ওদের সাথেই।
ফরেষ্ট গার্ডের পিছু নিয়ে দুপাশের গা-ঘেঁষা গাছ-গাছালির ফাঁক গলে এগোলাম ফিকে আঁধারে ঢাকা সরু পায়ে চলা বনপথ ধরে। খানিকটা যেতেই বন ফাঁকা হয়ে এলো। একটা বিশাল ঘেসো মাঠের প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। আমাদের একটু ডানে বড়ো মাঠটার মাঝখানটা ধরে ফুট তিনেক উঁচু সরু একটা জাঙ্গাল চলে গেছে দূরে-পুবের ঘনায়মান অন্ধকারে। জাঙ্গালটার গায়ে হালকা ঝোপঝাড়। বেশ খানিকটা দূরে সিকি মাইলটাক হতে পারে- ফিকে অন্ধকারে দেখলাম একটা মানুষ একাকী একটা ঘাসের বোঝা মাথায় করে আমাদের বাঁ দিকে কচি খালের পাড়ের জঙ্গলের জটলার দিকে যাচ্ছে। নিশ্চয় খালে ডিঙ্গি ভিড়ানো। খানিকটা গলা উঁচিয়ে ফরেষ্ট গার্ড ডাকতেই লোকটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ফের চলতে লাগলো নিজের গন্তব্যে। বাওয়ালিরাতো কিছু সময় আগে ও দিকেই বাঘটাকে দেখে এসেছেন শেষমেশ। সদ্য শিকার হারানো ক্ষুধার্ত জানোয়ার, আর সেদিকেই যাচ্ছে মানুষটা। সুন্দরবনের খুঁটে খাওয়া হতদরিদ্র মানুষদের জীবনের বাস্তবতাটা এমনি কঠিন বটে।
আমরা ডানে ঘুরে ডানপাশের জঙ্গল ঘেঁষে খানিকটা এগিয়ে যেতেই বিশ-পঁচিশ গজটাক দূরে দেখলাম হরিণের এক বিশাল গণসমাবেশ। যেন কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের শুরুতে প্রধান বক্তা কেবল গলা খাঁকারি দিয়েছেন মাইকের সামনে, বক্তৃতা শুরু হল বলে। শ্রোতাদের পিনড্রপ সাইলেন্স। মালি (মাদি), শিঙ্গাল, গেদা, বুড়ো, সবাই গা ঘেঁষা ঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে এক সাথে রাতটা কাটাবে বলে। শিংয়ের ছড়ানো ছিটানো ডালপালা নজর করে দেখে মালি আর শিঙ্গালের তফাল্টা মালুম হচ্ছিলো। গায়ের মনোহর পোষাকের রং কিংবা ছিট না দেখতে পেলেও জানা ছিলো এরা সবাই সুন্দরবনের অলংকার চিত্রল হরিণ।
আঁধার একটু গাঢ় হতে টর্চের আলো ফেললাম। আলোর প্রতিফলনে ঝিক-মিকিয়ে ওঠে হাজার চোখের লহর। এখানে এই গা ঘেঁষা-ঘেঁষি ভিড়ে মাঝে মধ্যে খটাখট শব্দ জানান দিচ্ছিলো শিঙ্গালদের ঘরোয়া বিবাদ মিটানোর প্রয়াস। ওই জঙ্গলে কতো হরিণ হবে? পাঁচশো? সাতশো? না আরো বেশি? তা কে যাবে গুনে দেখতে? টর্চের আলো যতোদূর যাচ্ছে, কেবল আলোর প্রতিফলন। বাঘের ভয়ঙ্কর থাবার নিচে জীবন কাটানো তৃণভোজী প্রাণীদের আপাত নিরাপত্তার প্রয়োজনে একাট্টা হয়ে রাত কাটানোর সম্মিলিত গণ-উদ্যোগ। সহসা বনে এসেই এমন হরিণের বিশাল ঝাঁক দেখা আজকাল খুব একটা ঘটে না। উদ্যোগী ফরেষ্ট গার্ডকে ধন্যবাদ জানিয়ে কটকার ঘাটে নামিয়ে দিয়ে তারার মলিন আলোয় নদীপথের উজানে ছুটলাম এক নিরুদ্দিষ্ট লঞ্চের সন্ধানে।
৩. দুপুর গুড়িয়ে বিকাল তখন। মুরগী খোঁজার উসিলায় সুন্দরবনের দাপুটে ডিএফও আলী আকবর ভূঁইয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার বড়োসড়ো জলশকট ‘বনকন্যা’ ছেড়ে স্থানীয় এক জেলের ডিঙ্গিতে চড়লাম। বুড়ি গোয়ালিনীর চুনার গাঙ্গ থেকে ভাঁটার টানে খোলপেটুয়ার প্রশস্ত বুকে পড়লাম বন গবেষনা প্রতিষ্ঠান-এফআরআইয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তা মীর মোহাম্মদ হাসান সাহেব আর আমি। হাসান সাহেব আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বেলজিয়ামে ডক্টরেট ও তারপর পোষ্ট ডক্টরেটও করেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এফআরআইয়ের পরিচালকের পদ থেকে অবসর নেন। গত আঠারো সালের ডিসেম্বর পঁচিশের রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চির বিদায় নিলেন বন্ধুবর পরম সাহসী অনুসন্ধিৎসু গবেষক ড. হাসান। পরম করুণাময়ের আশ্রয়ে তাঁর আত্মা চির শান্তিতে থাকুক!
বড়ো নদী খোলপেটুয়া ধরে কিছুটা ভাঁটিতে নেমে ডান তীরের একটা সরু বাঁকা খালে ঢুকলাম। খালে ঢুকে দখিনমুখী বাঁক নিতেই বন মোরগের কটকট শব্দের সতর্ক বার্তা পেলাম। কোনো মাংসাশী জানোয়ার দেখে বৃক্ষশাখার নিরাপত্তায় চড়ে বনের তাবৎ নিরীহ বনবাসীদের জানিয়ে দিচ্ছে বিপদ বার্তা। চুলের কাঁটা বাঁকটা ঘুরে খালের দখিন পাড়ের হেঁতালের ঘন ঝাড়ের পাশ দিয়ে পশ্চিমমুখো হলাম। ভাঁটার টানে পানি কমে যাচ্ছে। ডিঙ্গির পাটাতনে দাঁড়িয়েও হেঁতাল ঝোপের আড়ালের ডাঙ্গা তেমন দেখা যাচ্ছেনা। খানিকটা এগোতেই হেঁতালের ঝাড় শেষ। দুই তিন ফুট উঁচু হুদো বা টাইগার ফার্ণের ঘন ঝোপ। তারপর উঁচু গাছ-গাছালির ঘন জঙ্গল। আমাদের ‘মেজবান’ ওদিক থেকেই এসেছেন ‘মেহমানদারি’ করতে; একটু পরই টের পেলাম।
সামনে খালের দখিন পাড়ে একটা মরা গাছের ডালে বাদামি শালিকের ঝাঁক। লোকালয়ে দেখা ভাত শালিক। আমাদের ডিঙ্গি যখন গাছটা বরাবর খাল ধরে যাচ্ছে, হঠাৎ শালিকের ঝাঁক কিচির মিচির আওয়াজ তুলে হুড়োহুড়ি করে সবকটা পাখী নিচু উড়ালে খুব দিকে গেলো লুকনো কিছু একটা জানোয়ার লক্ষ্য করে।
ডান পাড়ের ঝোপঝাড় একটু হালকা আর পাড়টা খানিকটা নিচু। অনেক দূরের বন থেকে শিঙ্গালের সতর্ক চিৎকার ভেসে এলো। ‘অ্যাঁইয়ো-অ্যাঁইয়ো’- যেন এক করুণ বিলাপের ধ্বনি। হরিণের বিপদসূচক সতর্ক আওয়াজ। উত্তরে চুনারের কাছাকাছি হবে। মোরগ, হরিণ, বানর এরা বনের চৌকিদার বটে।
কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আসা, তার হদিস নেই। এ সময়টা মোরগ-মুরগী একটু খোলামেলা জায়গা, নদী-খালের কিনারে ছোট ঝোপঝাড়ে পোক-মাকড় খুঁটে খায়। আজ তাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। যতো ভজকট লাগালো সেই অদৃশ্য ঝামেলা- যার মোকাবেলা করছে ভাত শালিকের ঝাঁক। যার আগমন বার্তা বনমোরগ খালে ঢুকতে না ঢুকতেই জানিয়ে দিয়েছিলো। এদিকে ভাঁটার টানে খালের পানি দ্রæত নেমে যাচ্ছে। সামনে খাল আরো সরু। নৌকা ঘুরাতে অসুবিধা হবে। তাই ছোকড়া মাঝিকে ডিঙ্গি ঘুরাতে বলতেই সে তাই করে। তাও ডিঙ্গির দুমাথাই খালের দুকূলের মাটি ঘষ্টে গেলো। ভাঁটায় সরু খালের পানি যখন তলানিতে, দুপাড়ের উঁচু ডাঙ্গা সুন্দরবনের জঙ্গলে খুবই বিপদজনক। শালিকের ঝাঁকটা মস্তো সরগোল তুলে দখিন পাড়ের হুদো বনে আমাদের অদেখা জানোয়ারটার পিছে লেগেছে বেচান হয়ে। মাঝে মাঝেই এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে জানোয়ারটাকে প্রায় ছোঁ মারছে। চুপিসারে শিকারে এসে এমনভাবে বেমক্কা ধরা পড়ে গিয়েও শিকারী জানোয়ার একটা শব্দও করছেনা। বেচারি চোরের মতো পশ্চিম থেকে পুবে আবার পুব থেকে পশ্চিমে যাচ্ছে আর পাখীরা লো-ফ্লাইটে তাকে অনুসরণ করছে সরবে। শালিকের উত্তেজিত ঝাঁকটা তাদের গাঢ় বাদামির সাথে উজ্জ্বল সাদা ছোপমাখা পাখা ঝাপটে তাড়া করছে শত্রুকে। অবশ্যই ওটা বাঘ। হরিণ-শূয়োরের সাথে শালিক কিংবা মোরগের কোনো বিসংবাদ নেই। কেবল মাংসাশী জানোয়ার দেখলেই ওদের যতো আতঙ্ক আর উত্তেজনা।
মোরগের প্রত্যাশায় এসেছিলাম। এখন আত্মরক্ষার তাগিদে বন্দুকের বিবি কার্টিজ বদলিয়ে এলজি লোড করেছি ইতোমধ্যে। আমার সতর্কতা দেখে বন্ধু হাসান সাহেবও মাঝির হেঁসোয়াখানা শক্ত মুঠিতে ধরে শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়ালেন ডিঙ্গির মাঝ বরাবর। যেন জবরদস্ত বাঘকেও ছাড় দেয়া যাবেনা কোনো রকম। বাঘটা নিঃসাড়ে এসে ঘাপটি মেরে বসার সুযোগ খোঁজার জন্য এসেছিলো। আমাদের কেউ ডাঙ্গায় নামলেই রাতের ডিনারটা হয়ে যায়। তারপর কিছু থাকলে কাল-পরশুর খোরাকও হয়ে যেতো। বাদ সাধে বেয়াদপ ছোটলোক শালিকের বেত্তমিজ দঙ্গল।
পানি বেজায় কমাতে হুদোবনের এমন গরমাগরম নাটকটা কমই দেখতে পেলাম। কেবল শালিকদের লো-ফ্লাইটে একবার পুবে, আবার পশ্চিমে একটা কিছু তাড়িয়ে নেয়াই কেবল দেখছিলাম। আমরা নিঃশব্দে ডিঙ্গি যতোটা সম্ভব বাঁ পাড় ঘেঁষে চললাম। হেতালের আড়ালে এসে একটু ভরোসা হলো, হেঁতালের কাঁটা ভেঙ্গে অরণ্যের মহারাজ কি নৌকায় ঝাঁপ দেবেন? শিকার হাত-ছাড়া হচ্ছে দেখে বেপরোয়া বাঘ কী করে না-করে তাওতো বলা যায় না। সাবধানের মার নেই নীতিবাক্য মাথায় রেখে, বন্দুকের বাঁট ডান কাঁধে সেঁটে নল দুটো ডানের ডাঙ্গার দিকে রেখে এক সময় খালের চুলের কাঁটা বাঁকটা পার হলাম। সামনেই খোলপেটুয়া। বড়ো নদীতে পড়তেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম এবারের মতো। শালিক পাখীরাই শিকার খোঁজা বাঘকে হতোদ্যম করে দেয়। পাখীরা ওখানে না থাকলে বা এতো মারমুখী না হলে আমাদের কেউ ডাঙ্গায় নামলে আর রক্ষা ছিলো না। পাঁচ-ছ’মনি সাক্ষাৎ যমের বিদ্যুৎ গতির আক্রমনের মুখে যদি বন্দুক চালানোও যেতো, তাও বারোবোরের শটগান দিয়ে ওই হামলা ঠেকানো যেতো কিনা সন্দেহ।
৪. সেবার যাত্রা শুরুতেই দেখা একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়। তখন বিকাল হয়ে এসেছে। ডিএফও সাহেবের লঞ্চখানা চাঁদপাইয়ের মৃগমারীর পর শেলা গাঙ্গের উত্তর প্রান্ত ছুঁয়ে উত্তর-পুব দিকের আড়োভারানী খালে সবে ঢুকেছে। আর বন জঙ্গলে এলেই আমার আদ্যিকালের নেশায় খালের দুকূলের বনেই চোখ রাখতে চেষ্টা করছিলাম। একবার ডানে একবার বাঁয়ে জলযানের ছাদে বসে। কারো আচমকা চিৎকার শুনেই বোধ হয় লঞ্চের ডান দিকে ঝুঁকে খালের প্রায় স্বচ্ছ পানির গভীরে চোখ রাখলাম। হায় খোদা, সেকী মস্তো কুমির-চৌদ্দ ফুটের কম নয়। সবজে ধূসর পিঠ। যেন কতোই না নিরীহ প্রাণী। প্রপেলারের শব্দেই ঘাঁপটি মেরে খালের তলার কাদায় গা মিশিয়ে শুয়েছিলো। তাবৎ কুমির গোষ্ঠীর মধ্যে বৃহত্তম ও হিংস্রতম প্রাণী লোনাপানির কুমির! এসচুয়ারাইন ক্রোকোডাইল।
সেদিন সন্ধ্যারাতে ধানসাগরের নিবিড় জঙ্গলে জনা দুই সাহসী ও নিরস্ত্র বনকর্মীকে অনুসরণ করে গিয়েছিলাম। বনের সরু পায়ে চলা পথে লোডেড শটগান হাতে বাঘের রাজত্বে অনুপ্রবেশকারী হয়ে সুন্দরবনের অন্ধকার রাতের ভীতিপ্রদ রোমাঞ্চ সত্য কথা বলতে কী-বেশ ভয়ে ভয়েই উপভোগ করেছিলাম। আর এটাও উপলব্ধি করলাম, আমার মতো সুন্দরবন-নবিশের হাতে বন্দুক বা রাইফেল যাই থাকুক না কেন, এই শার্দুল অধ্যুষিত বনে রাতে চলাফেরা করাটা উপভোগ্যতো নয়ই, নিরাপদও নয়।
৫. এ ঘটনার অনেক দিন পর খুলনা রেঞ্জের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অর্পনগাছিয়া বা আড়পাঙ্গাসিয়া আর মালঞ্চের দশ-বারো কিলোমিটার প্রশস্ত মোহনার পুবপাশের অভয়ারণ্যের সমুদ্র উপকূলে এক চাঁদের রাতে এক অপূর্ব নিভৃত নির্জনে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছু সময়। বন্ধু হাসান সাহেবকে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেশ রাত পর্যন্ত চাঁদনী রাতের এন্তার হাওয়া খেয়েছিলাম সমুদ্রের কাছে সৈকতের বালুচরে বসে। সময় আপন মনে সুনসান বয়ে যাচ্ছিলো নিঃশব্দ নীরবে মহা-অরণ্যের নিভৃত গহনে। আর অলস রাতের নিষুপ্তি ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো সাত সাগর ডিঙ্গানো দমকা মাতাল হাওয়ায় আর সাগরের শ্রান্তিবিহীন তরঙ্গ ভঙ্গে। দূরে, দক্ষিণ-পশ্চিমে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে, পতœী দ্বীপ যেন শুচিবায়ুগ্রস্তা এক দ্বিজকন্যার মতো বাংলাদেশের যাবতীয় অশৌচ স্পর্শ এড়িয়ে বসে আছে এক ধোঁয়াটে-কালো ফোঁটার মতো সাগরের গাঢ় ধূসর কোলে। জঙ্গল আমাদের থেকে বিশ-ত্রিশ গজ দূরে। বনের সীমানা ঘেঁষে একটু এ্যাবড়ো থেবড়ো বালিয়াড়ির কয়েক গজ বর্ডার, তারপর ঢালু সৈকত। হাওয়া আর ঢেউ-ভাঙ্গার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো সাড়া শব্দই ছিলো না। হাঁকডাকের ব্যাপারে বাঘ বেজায় সংযত। কেবল মিলনের আগ্রহে সাথী খোঁজার জন্য ডাকাডাকি করে, আর প্রতিদ্ব›দ্বী বাঘের সাথে লড়াই করার কালে আর শিকার ধরার মুহূর্তে কোন কোন সময় অথবা খুব রেগে গেলেই তর্জন-গর্জন করে। আর হরিণ বিপদ আপদেই কেবল বিলাপ তোলে। নিঝুম চাঁদনী রাত আমাদের যেন মোহগ্রস্ত করে রাখে।
এমন মায়াবী চাঁদের রাতে অতি সতর্ক দৃষ্টিরও ভুল হতে পারে। বালিয়াড়ি আর সৈকতের ধোঁয়াটে-ধূসর বর্ণের সাথে নিজের জ্যোৎস্না মাখা ধূসর গাত্র বর্ণ মিলিয়ে নিখুঁত ক্যামাফ্লাউজের আড়ালে বিপদজনক নৈকট্যে চলে আসতে পারে সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর। রাত বাড়তেই সহসা বোধ হলো নিজেরতো বটেই, সাহসী বন্ধুটির জীবনেরও বড্ডো ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। লঞ্চে পৌঁছার পথে ধারে কাছে ঘনিয়ে আসা বনের ছায়া, মিঠা পানির জন্য খোঁড়া অগভীর কুয়োটা, যা সন্ধ্যার আগে মনে হয়েছিলো মামুলি বিষয়- এসবইতো মহাবলের শিকারের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকার সুলভ ঘাঁটি। আর আমরা কি সারাটা সন্ধ্যারাত দু’দুটো লোভনীয় টোপ হয়ে অদৃশ্য কাউকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে যাইনি? যাক, তবুও বিপদের আশঙ্কা বুঝে সতর্ক হলাম। খুব সাবধানে বন্দুক তাৎক্ষণিক গুলি ছোঁড়ার জন্য তৈরি রেখে, গাছের ছায়া ঢাকা এলাকায় এসে টর্চ জ্বেলে সামনে, ডানের জঙ্গলে, বাঁয়ে নদীর প্রায় খাড়া পাড়ে আলো ফেলে- যতোনা বাঘ দেখার আশঙ্কায়, তার চেয়ে বেশি তাকে ঘাবড়ে দেয়ার প্রয়াসে এগিয়ে গেলাম পুব থেকে এসে আড়পাঙ্গাসিয়াতে পড়া খালের দখিন পাড়ে ভিড়ানো লঞ্চের উদ্দেশে। কূয়োর কাছাকাছি হতেই বাঁয়ে নদীর খাড়া ঢালে নেমে প্রায় পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলাম, যেকোনো আচমকা হামলা এড়াতে। অবশেষে লঞ্চে পৌঁছে গেলাম নিরাপদেই। সারেং বেচারিরও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে।
৬. বছর কতোক পরের কথা। সুন্দর বনের দক্ষিণ পুবে সাগর পাড়ে টাইগার পয়েন্টে বিকাল কাটিয়ে সন্ধ্যা লগ্নে গুমোট বনের পরিবেশ ছেড়ে রেঞ্জারের লঞ্চে নিরিবিলি রাত কাটালাম। সকাল বেলা যাচ্ছি বাঁয়ে কটকা রেখে ঝাঁপা বা জাফা খালের দিকে। ঝাঁপার আগে ভাঙ্গরা নদীর উজানে কিছু বাগদা চিংড়ি কেনা হল জেলে নৌকা থেকে। ঝাঁপায় ঢুকেই ডান পাশের চরে নতুন গেওয়া বনে নেমে মাটির নমুনা জোগাড় করা হলো। লঞ্চে উঠে খেয়াল হলো ছুরিটা ফেলে এসেছি গেওয়া বনে। তখন আবার ফিরে গিয়ে সেই ঝোপালো গেওয়া বনে মামার সাক্ষাতের ঝুঁকি নিয়ে ছুরি খোঁজার উৎসাহ আর ছিলোনা।
যাচ্ছি পশ্চিমে ঝাঁপা ধরে। যথেষ্ট প্রশস্ত ভরানী খাল ঝাঁপা। পাশে বসা বন্ধু হাসান সাহেব আমাদের পরিচিত, কিংবা আমার কম পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, সাবেক সহপাঠী কিংবা ইউনিভার্সিটির টিচারদের নিয়ে মজার মজার গল্প ফাঁদেন। আমরা বসেছিলাম সারেং ঘরের সামনে পাতা একটা বেঞ্চে। আমি খালের দুকূলের বন দেখছিলাম। সুন্দরবনের নিজস্ব নিসর্গ আর বনবাসী ছাড়া আর কোনো গাল-গল্পে তখন আমার মন ছিলোনা। পিপাসার্ত চোখ মেলে একাগ্র মনোযোগে দেখে যাই। যতোবারই এ বনে গিয়েছি ওই আমার একমাত্র নেশা-বাঘ দেখবো। অথচ একবারও স্পষ্ট করে সুন্দরবনের বাঘ দেখিনি।
ব্রিটিশের উপনিবেশ কাল থেকে অদ্যকার সময়েও বন্দুক-রাইফেলের উপদ্রবে বুনোজন্তু-জানোয়ার-পাখপাখালী প্রায় নিঃশেষ। সুন্দরবনের দুই প্রজাতির হরিণ-হগডিয়ার আর বারোশিঙ্গা আর নেই। মায়া হরিণ বা বার্কিং ডিয়ার নাফি কিছু আছে, তবে আমি দেখিনি। চিতাবাঘ, বুনো মোষ নেই, দুই প্রজাতির গন্ডার-এক গড়গধারী এশীয় গন্ডার আর একটু বেঁটে জাভা গন্ডার একশো বছর আগেই নাকি খতম। এখনও কালে ভদ্রে মাটির ফুটকতোক গভীরতা থেকে খোঁড়া খুঁড়িতে-গোপালগঞ্জের ঝোঁপা মাটির বিলের আশে পাশের এলাকা থেকে পশ্চিমে সাতক্ষীরা পর্যন্ত এলাকায় গন্ডারের মোটাসোটা হাড়গোড়, কঙ্কাল বের হয়ে পড়ে। আরো পশ্চিমে সীমান্তের ওপাড়েও।
গত ঊনিশশো সত্তর-আশি নাগাদ সুন্দরবনে নীল কমল খালের আশপাশে হরিণের ঝাঁক দেখেছি। বিশেষ করে বিকালে। রাতে হরিণ হীরন পয়েন্টে, নীল কমল খালের পাড়ে ভিড় জমাতো বিপুল সংখ্যায়। হয়তো জন-মনুষ্যের কাছাকাছি এসে বাঘের হামলা থেকে নিরাপত্তার জন্য। মালি, শিঙ্গাল, পিচিচ, বুড়ো সব্বাই। নিজের চোখেই দেখা। এইতো সেদিন মাত্র, ১৯৫০ এর দশকে সাংবাদিক ও শিকারী তাহাওয়ার আলী খান সন্ধ্যা রাতে একটা মানুষ খেকো বাঘিনী মেরেছিলেন নীলকমল খালের পাড়ে (Tahawer Ali Khan, Man Eaters of Sundarbans)। ঘটনা চক্রে ১৯৭৯ সালে আমিও-অবশ্যই একা নই সাথে লোকজন ছিলো- একটা প্রকান্ত রয়্যাাল বেঙ্গল খেদিয়ে বেড়িয়েছিলাম এই নীলকমলের বন ও খালে, সেও অজ্ঞাতসারে। অথচ ১৯৯৭ এর ডিসেম্বরে নীল কমলে কেবল রাতে মালি হরিণ দেখেছি। একটা শিঙ্গালও দেখিনি। শিকারীরা সাধারণত শিঙ্গাল শিকারেই আগ্রহী বেশি। বাঘের পাগমার্ক কমই দেখেছি এসময়। আমরা সেই গল্পের ধনী কৃষকের বোকা ছাওয়ালদের মতোই। বাপ-দাদার সহায় সম্পদ সবকিছু বেচে-থুয়ে খেয়েছি। এখন হাঁড়িতে ছুঁচোর কেত্তন!
ঝাঁপা খালে ফেরা যাক! সময় তখন আন্দাজ সকাল নটা-সাড়ে নটা। একটা বাঁকের বাঁ তীরের ‘ঠোটে’ একচিলতে বালি জমেছে। সেই বালির সৈকতে দু’দুটো বুনো শূয়োর বসেছিলো সকালের রোদ খেতে। আকাশ চিত্র বিশ্লেষণের যন্ত্র স্টেরিওস্কোপের আলাদা জোড়া বাইনোকুলারের একটা নিয়ে এসেছিলাম। ‘মনোকুলার’টা চোখে লাগিয়ে দেখছি মাঝে-মধ্যে। একটু এগোতেই বুঝতে পারলাম ওদুটো শূয়োর নয়-দু’দুটো হরিণ। আমাদের লঞ্চ আরো কাছে চলে আসতেই হরিণ দুটো সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। লঞ্চের সারেং সাহেবকে ইশারা দিতেই খালের বাঁ তীরের দিকে লঞ্চ নিতে শুরু করেন। গতিক সুবিধার নয় টের পেয়ে হরিণ যুগল বনের দিকে ফিরে দৌড়াতে শুরু করে। আর ধাবমান প্রাণী দুটোর ঝোলা পেটের এপাশ-ওপাশ দুলুনি দেখে আমি বলে উঠলাম, ‘বাঘ’। হরিণের পেট এতো ঝুলে থাকে না। দৌড়ালে এমন করে দোলেও না। ততোক্ষণে লম্বা লেজের এ পাশ-ওপাশ দোলাও বাঘের দৌড়ের সাথে চোখে পড়লো। এক জোড়া হুঁশিয়ার বাঘ দুলকি চালে দৌড়ে বনের আড়ালে চলে গেলো। সেবারই আমার সুন্দরবনের বাঘ এমন পষ্টৌ করে দেখা।
লঞ্চ ডান দিকে ঘুরে কাগাবগা খালে ঢুকেছে। বেলা বড়জোড় দশটা। কিছুটা এগিয়ে যেতেই খালের ডান তীরে দেখলাম একটা বড়োসড়ো ধলবক। সম্ভবত সুন্দরবনের ‘জাঠুয়া’ বক। পানি থেকে খানিকটা ওপরে। মনোযোগ পানির দিকেই। কাগাবগার একটা বাঁকে এসে লঞ্চ বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ফের ডানে ঘুরে খালের বড়ো বাঁকে পড়লো। এখানে খালের পানির ওপর দিয়ে দৃষ্টি বেশ খানিকটা দূরে যায়। পোস্ট-ব্র্রকফাস্ট গল্প আগের রেশ ধরে চলে। আর শ্রোতার মনযোগও সুন্দরবনেই। কারো অফিসেও নয়, ভার্সিটিতেও নয়। এক সময় বেশ দূরে খালের পাড় ভেঙ্গে পানিতে পড়ে উল্টে যাওয়া একটা গোল গাছের প্রকান্ড মুথা আর ঝাঁকড়া কালো শেকড়ও দেখলাম। মনোকুলারে ভালো করে চোখ রেখে দেখতে দেখতে একটু নড়াচড়া চোখে পড়তেই বোঝা গেলো, ওটা গোল গাছের ওল্টানো মুথা নয়। ওটা একটা বড়োসড়ো ধাড়ী বুনো শূয়োর। আমার মনোযোগ ওই প্রকান্ড ধাড়ী শূয়োরের দিকেই। খালের প্রায় মাঝ বরাবর পানিতে তার পরম আরামের স্নানপর্ব দেখতেই ব্যস্ত ছিলাম।
ওদিকে গল্প চলছে আপন গতিতে। শূয়োরটা মধ্যখালের একটু ডানে আর উত্তর পাড় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। খাল ওখানে পাশে একটু বেড়েছে। মার্চ-এপ্রিলের দুপুর-ঘেঁষা গরমে বেচারি গা শীতল করছে। কামট-কুমিরের পরোয়া নেই। তা থাকলে এই ঠান্ডা পানিতে অবগাহনের মজাটুকু থাকতো না। প্রাণীটা আরো একটু নড়তেই বুঝলাম ওটা একটা প্রকান্ড মাথা মাত্র। একটা কানও একটু নড়ে। কানের পেছনের কালোর মধ্যে সাদা ফুটকিটা পলকের জন্য স্পষ্ট দেখলাম। আর তাতেই সমুদয় গোলের মুথা-শূয়োর ইত্যাদির রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেলো। শূয়োর টুয়োর কিছু নয়- স্বয়ং রয়্যাল বেঙ্গলের একখানি প্রকান্ড মস্তক। আস্তে বললাম, হাসান সাব, সামনে বাঘ! বাঘের এতো সময় ধরে দেখা দূরবর্তী সাদা হাঁসের মতো কিছু একটা, তা বড়ো হতে হতে একটা মনুষ্যবাহী প্রকান্ড জলযান হয়ে গেলো। গুডু গুডু আওয়াজ তুলে এগিয়েই আসছে। বিষয়টা কী দেখার জন্য মহারাজ এবার খানিকটা ঘাড় বেঁকিয়ে সেদিকেই মনোযোগ দিলেন। কিন্তু খালের সেই জায়গা থেকে ইঞ্চিটুকুও সরলেন না। আমরা দুজন বেঞ্চের ওপরই বসেছিলাম। এবার বাঘ দেখার উত্তেজনায় দুজনেই বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে গেলাম। চরম ঔৎসুক্যে, বনের মহারাজকে ভালো করে দেখবো বলে। দ্রæত একসময় কেবল বন্দুকের রেঞ্জেই নয়-সোজা ঢিল-ছোড়া দূরত্বে এসে পড়েছি। কিন্তু মহারাজের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্যই দেখা গেলো না। বাঘ কেবল এগিয়ে আসা লঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছিলো আর কোনো নড়াচড়া নয়। ভাবখানা এই ‘এসেছো যখন বাবাজী, তোমার পথে চলে যাও, আমার গোসলে বাগড়া দিয়ো না।’
আমাদের ইশারায় সারেং গতি কমিয়ে লঞ্চের মাথা ঘোরালেন সামান্য ডানে। লঞ্চ একটু এগিয়ে যেতেই এবার মহারাজের চৈতন্য হলো- না: বেটাদের মতলব সুবিধার বোধ হচ্ছে না। বেয়াদপের হদ্দ মানুষগুলো অতোবড়ো জিনিসটা গায়ের ওপরই তুলে দেবে নাকি? সত্যি বটে, লঞ্চ ততোক্ষনে বাঘের প্রায় পনেরো-বিশ হাত দূরত্বে চলে এসেছে।
সাইমোটা গর্দানখানা তীরের দিকে ঘুরিয়ে- তাও খুব একটা তাড়াহুড়ো করে নয়- লাফ দেয়ার উদ্যোগ নিলো বাঘ। তখনো মনোকুলারের মধ্য দিয়েই দেখছিলাম। কালো ডোরা কাটা আগুনে বর্ণের ঝকঝকে দেহখানা একটা বিশাল বেরেলের মতো পানি থেকে উঠছেতো উঠছেই। সে উত্থানের যেন শেষ নেই। তারপর যেন বিদ্যুৎ ঝলকের মতো উড়ে গিয়ে ডাঙ্গার কাছেই বাঘ অল্প পানিতে পড়ে সুন্দরবনের প্রেম কাদার গভীরে থাবা দু’খানা সেঁধিয়ে দিলো। আমি ভাবলাম বাঘ বাবাজীর কেরামতি দেখবো এবার। ওই ভীষন আঠালো প্রেম ঘন নিবিড় বন্ধন কীমতে ছিন্ন করে শার্দুল বাবাজী ডাঙ্গায় ওঠেন, দেখা যাবে। সুন্দরবনের প্রেম কাদার আকর্ষণী ক্ষমতার ভয়াবহতা তখনো আমার স্মৃতিতে তরতাজা ছিলো। বনের জোয়ারের পানিতে ভেজা কাদাটে ডাঙ্গায় চলা-ফেরার সুবিধা হবে বিবেচনায় সেবার হাসান সাহেব আনকোরা নতুন একজোড়া গামবুট সাথে এনেছিলেন। ডাঙ্গায় সদ্য ভিড়ানো লঞ্চ থেকে নামার জন্য কাঠের প্ল্যাংকটা নামানোর অপেক্ষা না করেই আমার বারণ সত্বেও সবুট লাফিয়ে নামতে গেলেন হয়তো বুটের কার্যকারীতা টেস্ট করার জন্যই। নামতেই কপাৎ করে তীর সংলগ্ন কাদার গভীরে বুট সহ হাঁটু অবধি দেবে গেলেন। তিনি আরতো উঠতে পারছেন না। নড়াচড়া করাও সম্ভব হচ্ছে না। পিয়ন মাওলা আগেই ডাঙ্গায় নেমেছিলো লাফ দিয়ে। তার আপ্রাণ চেষ্টায় শত টানাটানি করেও সাহেবকে নড়াতেই পারলো না মাওলা। ভাগ্যিস অমন প্রচন্ড টানা হ্যাঁচড়ায় সাহেবের হাত ছিঁড়ে আসেনি। আমার নামতে যাওয়ার আগেই রিইনফোর্সমেন্ট এসে গেলো। এক তাগড়া জোয়ান খালাসী লাফিয়ে শুকনো ডাঙ্গায় নেমে নদীর ঢালুতে গিয়ে মাওলার সাথে যোগ দেয়। তাদের যৌথ টাগ-অব-ওয়ারে হাসান সাহেব কাঁদা থেকে মুক্ত হলেন। কিন্তু গামবুট জোড়া রয়েই গেলো কাদার গভীরে। কাপড় গুটিয়ে কাদায় নেমে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে পেতে বুট দুখানাই টেনে তোলে মাওলা। ফের ডাঙ্গায় নামতে হাসান সাহেব আর বুট পড়লেন না। সেদিন নগ্ন পদেই গেলেন বনে। তারপর তাকে সুন্দরবনে আর কখনোই গামবুট পড়ে নামতে দেখিনি।
আমাদের শার্দুল বাবাজীর এহেন প্রেম কাদার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু অবাক কান্ড! আমাকে কোনো মজা দেখার পলক মাত্র সুযোগ না দিয়েই- ওই গভীর কাদা-টাদা যেন কিছুই নয়- অক্লেশে সামনের থাবা দুটো কাদা থেকে বের করে আরেকটা ছোট লাফে বাঘ ডাঙ্গায়। খালের সামান্য ঢালে গেলপাতার ছোটো ঝোপের পাশে। তবে তার মধ্যে মোটেই পালানোর তাগিদ ছিলো না। সেই অদম্য ঔৎসুক্য নিয়ে এই অদ্ভুত জলযান আর তাতে আশ্রিত দুবলা মানুষগুলোর দিকেই তার অখন্ড মনোযোগ। এই দেখাদেখির উৎসাহ যেন আমাদের চেয়ে বাঘের একরত্তি পরিমানও কম ছিলোনা। ভাবখানা এমনি ছিলো যেন আমাদের কেউ ডাঙ্গায় নামলেই করমর্দনের জন্য কাদা মুছে ডান থাবাটা বাড়িয়ে দিয়ে বাঘ বাবাজী বলতো, হাঁউম, কেমন আছো? কোমরটা একটু বাঁকিয়ে ঘাড়খানা ডান দিকে ঘুরিয়েপ্র্রকান্ড মাথাটা একটু কাৎ করে আমাদের দেখছিলো গভীর কৌতূহলে। দীঘল লেজটা ইষৎ বাঁকিয়ে। বাড়তি কোনো চাঞ্চল্যই দেখলাম না তার মধ্যে, কোনো অহেতুক সতর্কতা, বিরক্তি বা ভয়- কোনোটাই ছিলো না, নিঃসাড়ে দেখে যাচ্ছিলো আমাদের যেন নিছক কৌতুহলেই। সহসা গুলির প্রচন্ড বিস্ফোরণ। পলকের মধ্যে বাঘও লেজ তুলে এক লাফে উধাও ডাঙ্গার নিবিড় বনের আবডালে। চমক ভাঙ্গতেই খোঁজ পড়ে, কে গুলি করেছে? কোত্থেকে করেছে? আমি ভাবলাম বেঞ্চের ওপর রাখা গুলিভরা আমার বন্দুক থেকেই বুঝি মিস ফায়ার হয়েছে। ব্রীচ ভেঙ্গে কার্তুজ দেখলাম দুটো নলেই অক্ষত, আনাম। তাহলে? ফরেষ্ট গার্ড দুজনকে ডাকা হলো লঞ্চের ছাদে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেলো। নিচের ডেকে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো জটলা থেকে আমাদের দুজন গার্ডের মধ্যে একজন গুলি করেছেন তার সার্ভিস রাইফেল থেকে। এতো কাছে থেকে বাঘ দেখার উত্তেজনা সামলাতে না পেরে, নাকি সুন্দরবনের জলজ্যান্ত প্রকান্ড একটা বাঘ শিকারের এমন সহজ একটা মওকা মিস করতে অনীহার কারণেই গুলি করে বসেছেন বেঅকুফ লোকটা। অথবা ওপর থেকে আমাদের কারো গুলি করতে না দেখে অধৈর্য্য হয়ে কিংবা এই ভেবে যে, বাঘের ভয়ে বেজায় আতঙ্কিত হয়ে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বেচান হয়ে পড়েছি। তাই ওই ভয়ঙ্কর বাঘের আন্ড হামলা থেকে আমাদের রক্ষার তাগিদেও এমনটি করতে পারেন। তবে বাঘ বাবাজীর শা-কপাল! মাত্র পনেরো বিশ হাতের ফারাকে ইয়া দশাসই টার্গেটে প্রায় একই লেভেল থেকে ছোঁড়া গুলিও মিস! লজ্জায় থ্রি নট থ্রি বুলেট কাদায় সেঁধিয়ে মুখ লুকিয়েছে! তবে বাঘ বাবাজীর মা-বাপের জবর দোয়া ছিলো!
আমাদের ক্ষয়িষ্ণু বনজ সম্পদকে বাঁচিয়ে রাখা, আর বনের বিরল প্রাণীকুলকে হত্যা করবার সুযোগে কেবলই নিধন না করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই এদের বাঁচিয়ে রাখা, ওদের জীবনের অনুকূল পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখে ওদের বাঁচতে দেয়া এদেশের প্রতিটি মানুষের নাগরিক দায়িত্ব। কিন্তু এই জ্ঞানটার, দায়িত্ব বোধটার নিদারুন অভাব আমাদের সমাজে, আমাদের দেশে। অন্ততপক্ষে যাঁরা এই প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে কিছুটা ধারনা রাখেন, বনের ও বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে নাগরিক দায়-দায়িত্বের কথা ভাবেন-তাঁদের একটা বড়ো কর্তব্য ছিলো- যারা এসব নিয়ে ভাবেন না, বা গ্রাহ্য করেন না- তাদের মধ্যে এই দায়িত্ববোধটা জাগিয়ে তোলা, বন ও বন্যপ্রানী রক্ষার একটা শুভ সুযোগ সৃষ্টি করা। আমরা তা করিনি। করছিওনা। হয়তো সব প্রাকৃতিক সম্পদ নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত তা করবার তাগিদও বোধ করবো না। এটাই বোধ হয় আমাদের সর্বগ্রাসী জাতীয় ভবিতব্য। আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা কি আমরা জানি? তখন বেলা এগারোটা। এই অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র একটা সকালে তিন তিনটা জলজ্যান্ত রয়্যানল বেঙ্গল দর্শন নেহাৎ একটা মামুলি বিষয় নহে, বাহে!
৭. সেদিন সকাল নাগাদ আঠারো নম্বর কম্পার্টমেন্ট বাঁয়ে রেখে আমরা বনের উজানে যেতে একটা ছোটো মরানী খালের মুখে দেখলাম পানিতে পোঁতা একটা ভাঙ্গা ডালের ডগায় ন্যাকড়া মতো এক টুকরা কাপড় ঝুলছে তাবৎ দুনিয়ার বিষাদ নিয়ে। সুন্দরবনের এক অতিশয় নিভৃত নিবিড় অরণ্য কোলে এক ক্ষুধার্ত বাঘের ভয়াল থাবার কবলে পড়ে এক হতদরিদ্র মানুষের প্রাণ হারানোর মতো এক নিদারুন নির্মম ঘটনার শোকার্ত সাক্ষী!
নালাটির পাশেই ডাঙ্গার কোলে লঞ্চ ভিড়িয়ে নামলাম। জায়গাটা কিছুটা ফাঁকা, নিবিড় আঁধারপনা অরণ্য খানিকটা দূরে একটা কেমন যেন মারমুখো অমঙ্গলের আবহ নিয়ে দাঁড়িয়ে। খুব কাছের ঝোপঝাড় বলতে গজ বিশেক দূরে ডান দিকে কটা বেঁটেপনা হেঁতালের ঝোপ কিছুটা ফাঁকা ফাঁকা। একটা নরখাদক বাঘের পক্ষে অতর্কিত হামলার সুযোগ নিতে গা ঢাকা দিয়ে ওই ঝোপকটা পর্যন্তই এগোনো সম্ভব। আমরা আর না এগিয়ে কাছের একটা জায়গা থেকে মাটির নমুনা যোগাড় করি। মাটি সংগ্রহের প্রায় সবটা সময় হেঁতালের ঝোপগুলোর দিকে সতর্ক নজর ছিলো। আমরাতো তো আর সুন্দরবনের বনবিবির বাহনটিকে নিজেদের রক্ত মাংসের দেহখানা ভেট দিতে অতোশতো মাইল ডিঙ্গিয়ে আসিনি!
এই থম-মেরে থাকা গুমোট বনের সকালটাও কেমন যেন আধো অন্ধকার-নিরানন্দ-বিষাদময়। এই নিবিড় প্রায় অন্ধকার বনের কোন কোলে কবে, কখন ওই হতভাগ্য মানুষটাকে হত্যা করেছে নরখাদক বাঘটা- কোথায় তার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাপ্লুত লাশটা নিয়ে ভোগে লাগিয়েছে-কে জানে। উত্তরের মানষালয়ে কোন গাঁয়ের নিভৃত পর্ণকুটিরে নিহতের অসহায় বিধবা, আর এতিম ছেলে-মেয়ে, কিংবা সদ্য সন্তানহারা কোনো এক বিধবা বৃদ্ধামাতা শোকে ভাঙ্গা বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন-কোথায় কে জানে! আঠারো নম্বর কম্পার্টমেন্টের বিষন্ন কোল পেছনে রেখে আমরা চললাম আরণ্যক নদীটির আরো উজানে।
(বি.দ্র. লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সতীর্থ সম্মিলন ১৯৫৮-১৯৬২ এর স্মরণিকা ঢাকা, আগষ্ট-২০১৯ থেকে সংগৃহীত)