আমেরিকা প্রবাসী মজিদ আলী ইতিহাসের কিংবদন্তী
- প্রকাশের সময় : ০৮:২৭:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০১৯
- / ৭৪৭ বার পঠিত
সালাহউদ্দিন আহমেদ: সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের কোলে কলম্বাস আবিষ্কার করেন আমেরিকা। কলাম্বাসের সেই আমেরিকা আজ বিশ্ববাসীর কাছে স্বপ্নের দেশ। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই যার নাগরিক নেই এই আমেরিকায়। বিশ্বের যেকোন প্রান্তের যেকোন মানুষের স্বপ্ন আমেরিকা। এমন কল্প দেশে কার না আসতে ইচ্ছে হয়। না, আমেরিকা আজ আর কল্প রাজ্য নয়। সভ্যতার শৈশব, কৈশোর, তারুন্য আর যৌবন পেরিয়ে আমেরিকা আজ পূর্ণ যৌবনা। আমেরিকা আজ সকল শক্তিতে বলিয়ান, বিশ্ব দরবারে শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্র। বিদ্যা-বুদ্ধি, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি সব মিলিয়ে একক পরাশক্তির অভিধায় অভিষিক্ত আমেরিকা। যাকে সবাই যুক্তরাষ্ট্র বলেই অভিহিত করা থাকে। আর বাঙালী-বাংলাদেশীদের কাছে আমেরিকার পরিচয় ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’। বলতে দ্বিধা নেই যে, কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশের বাঙালী-বাংলাদেশীদের অন্যতম আবাস স্থল আজকের আমেরিকা। বিশ্বের রাজধানী বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সহ নিউজার্সী, কানেকটিকাট, পেলসেলভেনিয়া, মেরিল্যান্ড, মিশিগান, ভার্জেনিয়া, টেক্সাস, জর্জিয়া, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, সাউথ ক্যারোলিনা প্রভৃতি রাজ্য আজ বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাজ্যে পরিণত হয়েছে।
অথচ এক দশক আগেও বাংলাদেশীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগমন ছিলো দু:সাধ্য। অবশ্য ৯০ দশকের অভিবাসন আইনের পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশী সহ বিশ্বের অনেকে দেশের মানুষদের জন্য আমেরিকার দরজা খুলে যায়। এমনি এক দু:স্বপ্নকে বাস্তবে এবং দু:সাধ্যকে সাধ্যে আনা বাংলাদেশীর নাম মজিদ আলী।
সেই ১৯২০ সালের কথা। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। কারো কাছে শুনতে হয়তো অবিশ্বাস-ই লাগবে যে শতবছর আগেই এক সিলেটী বাঙালী আমেরিকার হলিউড জয় করেছিলেন। স্বপ্নবাজ, দূরন্ত নাবিক, বাঙালী এই কলম্বাসের নাম মজিদ আলী। তিনি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার পূর্ব বাউরবাগ গ্রামের সন্তান।
জানা গেছে, বাংলাদেশের সিলেট জেলার সন্তান মজিদ আলী ভারতের মুম্বাই নৌবন্দর থেকে পাল তোলা জাহাজে চড়ে ১৯২০ সালে আমেরিকা আসেন। তারপর আমেরিকাতেই থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিজের স্বপ্ন, প্রতিভা আর গুণে গড়ে তুলেন বর্ণাঢ্য জীবন। বিশ্বখ্যাত হলিউড-এ অভিনয় করে নিজেকে খ্যাতিমান করে তুলেন।
ইতিহাস বলেন, ১৮৯২ সালের ৫ ডিসেম্বর সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার নিভৃত অঞ্চল সুরমা তীববর্তী গ্রাম পূর্ব বাউরবাগে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। জন্ম সূত্রেই নদী আর প্রকৃতির সাথে তার মুধর সম্পর্ক। বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী আর নির্জন গ্রামের প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে তোলে। সুরমা নদীর বুক চিরে পাল তোলা নৌকার আসা-যাওয়ার দৃশ্য তাকে যেনো অজানা দেশ ভ্রমণের হাতছানী দেয়। স্বাভাবিক কারণেই তখন কানাইঘাট সহ আশপাশের অঞ্চল প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় নৌকাই ছিলো সে অঞ্চলের জনমানুষের চলাচলের প্রধান বাহন। সে নদীতে তখন নৌকার পাশাপাশি স্টীমারও চলাচল করতো।
প্রসঙ্গত: নদী মাতৃক বাংলাদেশের বাহন হিসেবে নৌকার ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকে। লোহা আবিষ্কারের আগে মানুষ কাঠের তৈলী নৌকা ব্যবহার করা শুরু করে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইঞ্জিন আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশ-বিদেশ ভ্রমণের জন্য নৌকাই ছিলো একমাত্র আবলম্বন। তখন বিশাল আকারের নৌকাগুলো সমুদ্রে পাল তুলে চলাচল করতো। পাল এবং বাতাসের ওপর নির্ভর করে চলা নৌকা নামক জাহাজ নিয়েই ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করেন। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিইয়েন সাং নৌকায় চড়েই বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন।
জানা যায়, মজিদ আলীর বয়স যখন ২৪ বছর, তখন তিনি কাউকে না জানিয়ে একদিন অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন। চলত চলতে এক সময় পৌছে যান ভারতের বিখ্যাত বোম্বে শহরে। সেখান থেকেই মূলত: তার সংগ্রামী জীবন শুরু। কিছুদিন তিনি সেখানে অবস্থান করার পর আমেরিকার ইউএসএ এসএস ফোর্স সিটি লাইন-এর একটি জাহাজে চাকুরী পেয়ে যান। সেই চাকুরীর সুবাদে শুরু হয় তার রোমাঞ্চ ঘেরা নতুন জীবন।
চাকুরীর সাবাদে-ই আজ এই দেশে তো কাল ঐ দেশে। এভাবে চজলতে চলতে একদিন পারি জমান আমেরিকা। ইউএসএ এসএস ফোর্স সিটি লাইন-এর জাহাজে ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সমুদ্র বন্দরে এসে নামেন। একটানা দীর্ঘদিন তিনি এক সাথে অবস্থান করে জাহাজে অবস্থানকারী সবার প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্রে পৌছার পরই তিনি ঔ জাহাজ কোম্পানীর এসএস সিটি অব হারবর নামে তাদের লোকাল লাইনে কাজ করার সুযোগ পান। তিনি ১৯২০ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করার জন্য ইউএসএ সরকারের কাছে প্রথম আবেদন করেন। তার Alein Registration No. 1064758. পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে তিনি জাহাজ কোম্পানীর কাজ ছেড়ে দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি Horse Ranch-এ কাজ শুরু করেন। নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ায় কয়েক বছর কাজ করতে করতে এই দেশটি তার ভালো লেগে যায়। ফলে তিনি স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের জন্য ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ সিটিজেনশীপের জন্য আবেদন করেন। তার Application No. ছিলো 1064758. . তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে তাকে Social Security Card No. 546-12-1847 প্রদান করা হয়।
নানা প্রতিভা আর সৃষ্টিশীল মেধার অধিকারী মজিদ আলী বিশ্বখ্যাত হলিউড-এ অভিনয় করেন। তিনি ১৯৪২ সালে হলিউডের Motion Picture ছবিতে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যান এবং পরবর্তীতে নিয়মিত অভিনয় করেন এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তার Hollywood ID Card No. ছিলো 42359. সেই সময় তিনি অভিনেতা রোনাল্ড রিগ্যান (পরবর্তীতে যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট)-এর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর সাথেও অভিনয় করার সুযোগ পান।
পরবর্তীতে অভিনয়ে সাময়িক বিরতি দিয়ে তিনি ১৯৪৪ সালে আমেরিকান কোস্ট গার্ড ও নেভিতে কিছুদিন কাজ করেন। সেই সময় তিনি Ammity Valle নামের এক আমেরিকান নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার Marriage Certificate No. 4310. Dated 16-02-1944. তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন ১৯৫২ সালের ১৪ মার্চ। তার সিটিজেনশীপ কার্ড নম্বর ছিলো- ৬৯৩১১২১.
পরবর্তীতে মজিদ আলী আবার অভিনয় শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন এসইজি (স্ক্রীন এক্সট্রাস গিল্ড) নামের একটি কোম্পানীতে (আইডি নং ৪৩৭৩)। এরপর তিনি চেকস নামের একটি ফিল্ম কোম্পানীর সাথে যুক্ত হন এবং অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকেন। Paramount Picture, Warner Bross Picture, Twentienth Century Fox Film Corporation-এর তৈরী বিভিন্ন ছবিতে তিনি এক্সট্রা অভিনেতা হিসেবে কাজ করতে থাকেন।
মজিদ আলী
১৯৫৭ সালে তিনি এই কোম্পানী থেকে অবসর নেন এবং নাড়ীর টানে ১৯৫৮ সালের প্রথম দিকে তিনি তার জন্মস্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ৬৬ বয়সে তিনি নুরজাহান বেগম (৩৮) নামের এক বাঙালী নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ১৯৬২ সালে তাদের ঘর আলোকিত করে এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। সন্তানের নাম রাখা হয় কুদরত উল্লাহ আলী। উল্লেখ্য, ১৯১৬ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তার কোন খোঁজ ছিলো না। তার কথা কেউ জানতো না যে, তিনি কোথায় কিভাবে ছিলেন।
জনাব মজিদ আলী আমেরিকান পাঠ চুকিয়ে জন্মভূমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও আমেরিকান শুভাকাঙ্খীরা তাকে মনে রেখেছিলেন। আমেরিকান দূতাবাস বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভুল করতেন না। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলো। ১৯৭৮ সালের ১৫ জুলাই তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
কুদরত উল্লাহ আলী ও তার পরিবার
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বসবাসকারী বাঙালী কলম্বাস মজিদ আলী সম্পর্কে পুত্র কুদরত উল্লাহ আলী বলেন, বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন, আদর করতেন। যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আমাকে তার চোখের আড়াল হতে দিতেন না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর জীবনের কাছে হার মেনে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে আমাকে চলে আসতে হয় বাবার স্মৃতিগাঁথা আমেরিকায়। বাবা কোনদিন তার কথা আমাকে জানাননি। না বলার কারণ বাবার ভয় ছিলো অন্য জায়গায়। আমার মনে আছে বাবা একবার পবিত্র হজ্বে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন আমাদের কাছেরই কিছু লোক তাকে বাঁধা দিয়ে বলেন যে, বিধর্মীদের দেশের রোজগারে নাকি তার হজ্ব আদায় হবে না। সেজন্য তিনি হয়তো ভয় পেতেন এবং তার এসব সিনেমার অভিনয়ের কথা শুনলে শেষে সবাই যদি তাঁকে ত্যাগ কবে বা আরো বড় কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
কুদরত উল্লাহ আলী বলেন- আমি বাবার সম্পর্কে জানতে পারি আমেরিকা আসার পর তার সম্পর্কে জেনে এবং তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পেয়ে। তিনি জানান, প্রায় ৩৮ বছর ধরে ধরে আমেরিকায় বসবাস করছি। বাবার বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করছি। আমার বাবা একই সাথে নাবিক জীবন, প্রবাসী জীবন আর অভিনয় জীবনের মেল বন্ধন রচনায় সক্ষম হয়েছি। আর বলতে দ্বিধা নেই তিনি আমেরিকায় বাঙালীর ইতিহাস, আমেরিকায় বাঙালীদের কলম্বাস।
কুদরত উল্লাহ আলী আরো জানান যে, আমার বাবার আগে বর্তমান সিলেটের কানাইঘাট অঞ্চলের কেউ আমেরিকায় এসেছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই। যদি তার আগে সে এলাকার কেউ আমেরিকায় পাড়ি না জমান তাহলে জনাব মজিদ আলী-ই হচ্ছেন প্রথম আমেরিকা প্রবাসী সিলেটী।
এদিকে নিউইয়র্ক তথা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি কামাল আহমেদ, জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব আমেরিকা সভাপতি বদরুল হোসেন খান, লীগ অব আমেরিকা’র সভাপতি বেদারুল ইসলাম বাবলা, সিলেট গণদাবী পরিষদের সভাপতি আজিমুর রহমান বুরহান, বাংলাদেশ বিয়ানীবাজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমিতি ইউএসএ’র সভাপতি মস্তফা কামাল পৃথক পৃথক বার্তায় যুক্তরাষ্ট্র তথা উত্তর আমেরিকায় মজিদ আলীর মতো কলম্বাসদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে বাঙালীদের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবী জানিয়েছেন।
(প্রতিবেদনটি তৈরীতে সিলেটের ডাক-এর সহযোগিতা নেয়া হয়েছে।)