নতুন জীবন শুরু করতে চলেছেন শ্যুটার আঁখি
- প্রকাশের সময় : ১১:৫৭:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪
- / ৭৯৫ বার পঠিত
নিউইয়র্ক: জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ স্ট্রিটের রাস্ত ধরে হাঁটছিলাম দ্রুতবেগে। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালেন এক পরিচিত মুখ। ‘আরে আঁখি না?’ লাভলী চৌধুরী আঁখি। সাফে স্বর্ণজয়ী শ্যুটার। সফল কোচ। আন্তরিক কুশল বিনিময়ের পরে টের পেলাম আঁখির সঙ্গে একজন পুরুষও আছেন। দু’জনের আচরণে বুঝতে পারলাম সম্পর্কটা বেশ গভীর। ভদ্রলোকের নাম কামরুজ্জামান বাচ্চু। কিছুদিন আগে তাঁদের এনগেজমেন্ট হয়েছে। এখন চলছে বিয়ের প্রস্তুুতি। জেনে খুব ভালো লাগল, দুঃসহ অতীত পেছনে ফেলে আঁখি পেয়েছেন নতুন জীবনের সন্ধান। আড়াই বছর আগে নাটোরের বনপাড়ার কাছে এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল আঁখির স্বামী ও আড়াই বছর বয়সী কন্যা সন্তানকে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেও কষ্টকর স্মৃতি পিছু ছাড়ছিল না মন থেকে। তাই একটা পরিবর্তন খুব প্রয়োজন ছিল আঁখির। সেটাই তিনি পেলেন নিউইয়র্কে এসে।
জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজার দোতলায় উঠলেই জননী ট্র্যাভেলস ও ট্যুরসের অফিস। সেখানে সিইও হিসেবে কাজ করছেন আঁখি। একদিন সেখানে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
‘জানেন আমার কুয়েতে যাবার সব ঠিক ছিল। কুয়েত শ্যুটিং ফেডারেশন আমাকে সে দেশের কোচ করতে চেয়েছিল। ভিসার কাগজপত্র চলে এসেছিল।’ হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন সদাহাস্যময় এক মানুষ আঁখি।
‘কুয়েতে কেন গেলেন না? এটা তো খুব ভালো প্রস্তাব ছিল…।’ বললাম আমি।
আঁখি বললেন, ‘আমি আসলে দীর্ঘমেয়াদি কিছু করার কথা ভাবছিলাম। এ জন্যই নিউইয়র্কে আসা। বাংলাদেশের সমাজ একজন নারীর একা থাকাকে ভালোভাবে নেয় না। এখানে সেই সমস্যা নেই।’
‘কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি আপনার ব্যক্তিগত জীবনেও তো বড় পরিবর্তন ঘটেছে?’
আঁখি লজ্জা পেয়ে হাসলেন। ‘ঠিক ধরেছেন। সেদিন যাকে আমার সঙ্গে দেখলেন, তিনি এই অফিসের চেয়ারম্যান। আমার সবকিছু জেনেই তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। ভেবেছিলাম, বাকি জীবনটা একাই কাটাব। কিন্তু আসলে এটা সম্ভব নয়।’
শ্যুটিং ছিল আঁখির একসময়ের ধ্যানজ্ঞান। আর এখন পড়ে থাকতে হয় সেভার নিয়ে। শব্দটার মানে নিউইয়র্কে আসার আগে জানতেনই না। এর অর্থ হলো টিকিট বুকিং দেয়া। ‘আমার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে কতজন বাংলাদেশে যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে, এটা ভাবতে খুব ভালো লাগে।’ বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অফিসে থাকেন আঁখি।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটেরও টিকেট বিক্রি করেন। খেলাধুলায় যেমন সফল হয়েছেন, নতুন জীবনে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়ও তেমনি নিজেকে সফল বলে মনে করেন আঁখি।
অথচ কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবেন না, কোনো দিন ঘর-সংসার আর শ্যুটিংয়ের বাইরে আর কোনো কাজই করেননি আঁখি। নিউইয়র্কে এসেছেনও গেল ২৪ আগস্ট। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নতুন পেশায় যোগ দিযেছেন। বর্তমানে নর্দার্ন বুলভার্ডে খালার বাসায় আছেন। জননী ট্রাভেলসের চাকরির ব্যাপারে খালাতো বোনরা সহযোগিতা করেছে। হবু স্বামী কামরুজ্জামান বাচ্চুর রিয়েল এস্টেট ব্যবসাও আছে। দু’জনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করার। ট্যুর প্যাকেজ করতে চান।
এভাবেই হয়তো আচমকা জীবনের গতিপথ পরিবর্তিত হয়! ছিলেন শ্যুটার। তারপর কোচ। এটাকেই জীবনের গন্তব্য ভেবেছিলেন আঁখি। কিন্তু একটা দুঘর্টনা এলোমেলো করে দিল সবকিছু। আড়াই বছর আগের ঘটনা। কোরবানি ঈদের পরে শ্বশুরবাড়ী পাবনা থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আঁখির স্বামী ও এক সময়ের দেশসেরা শ্যুটার ফিরোজ হোসেন পাখি নিহত হন। চিরতরে হারাতে হয় আড়াই বছর বয়সী শিশুকন্যা পুষ্পিতাকে। গাড়ী চালাচ্ছিলেন ফিরোজ। সামনের আসনে ফিরোজের পাশে বসেছিলেন আঁখি। পেছনে গৃহকর্মীর কোলে ছিল মেয়ে পুষ্পিতা। ওই গৃহকর্মীও মারা যান। পাবনা হাসপাতালে জ্ঞান ফেরে আঁখির। ততক্ষণে তাঁর স্বামী ও মেয়ের জানাজা ও দাফনের প্রস্তুতি চলছে।
সর্বস্ব খুইয়ে ঢাকায় ফেরেন আঁখি। সব কেড়ে নেওয়ার পরে সৃষ্টিকর্তার হয়তো দয়া হয়েছিল। তাই যে রকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবেন ধরে নিয়েছিলেন, তেমনটি ঘটেনি। ফিরোজ হোসেন ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শ্যুটিং দলের প্রধান কোচ। আঁখিকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। জাতীয় শ্যুটিং ফেডারেশনেও কোচিংয়ের দায়িত্ব পান। বেদনাদায়ক স্মৃতি ভুলতে আঁখির প্রয়োজন ছিল ব্যস্ততার। সেটাই তিনি পেলেন সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুল ইসলাম, শ্যুটিং ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজিমুদ্দিন চৌধুরী দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁডানোর কারণে। শ্বশুর বাড়ীর সবাই বিশেষ করে ফিরোজ হোসেন পাখির বড় ভাই সুলতান মাহমুদ আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। কুয়েতে শ্যুটিং কোচের চাকরির ব্যাপারে শ্যুটিং ফেডারেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর সহযোগিতা পেয়েছেন। ঢাকার মেট্রো শপিং মলে এক গয়নার শোরুমের অন্যতম অংশীদার আঁখি।
১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে দলগত ইভেন্টে স্বর্ণজয় আঁখির ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য। এর বাইরে সাফ শ্যুটিংয়ে স্বর্ণালী সাফল্য আছে তাঁর। নারায়ণগঞ্জের মেয়ে আঁখির শ্যুটিংয়ে হাতেখড়ি স্থানীয় শ্যুটিং ক্লাবেই। খেলা ছাড়ার পরে ২০০৭ সালে কোচেস কোর্স করেন। দেশ ছাড়ার আগে চলতি বছর জাতীয় এয়ারগান চ্যাম্পিযয়নশীপে শিরোপা এনে দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। খেলোয়াড়, কোচ ও বর্তমান পেশা সব চ্যালেঞ্জেই হয়েছেন সফল। শোককে রূপান্তরিত করেছেন শক্তিকে।
আর কিছুদিনের মধ্যে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছেন আঁখি। মানে পরিণয়ে আবদ্ধ হবেন কামরুজ্জামান বাচ্চুর সঙ্গে।
‘আগামী মাসে ওনার মা আসবেন। তার পরই আমাদের বিয়ে হচ্ছে।’ বললেন আঁখি।
তার মানে জননী ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান ও সিইওর এখন অপেক্ষা তাঁদের আসল জননীর জন্য।