দুই নক্ষত্রের পতন : মেসি-রোনালদোর কান্নার রাত
- প্রকাশের সময় : ০৪:৪৩:০২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩০ জুন ২০১৮
- / ১১৩৩ বার পঠিত
সামন হোসেন, কাজান (রাশিয়া) থেকে: জীবন কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর আর নির্মম। ফুটবলও তাই। নিষ্ঠুরতা কাল রাতে এক জায়গায় মিলিয়ে দিলো সময়ের সবচেয়ে বড় দুই তারকাকে। এক রাতেই বিশ্বকাপ দেখলো দুই নক্ষত্রের পতন। প্রথমে মেসি পরে রোনালদো। এতো শুধু দুই ফুটবলারের হৃদয়ভাঙার গল্প নয়। তামাম দুনিয়ায় তাদের কোটি কোটি ভক্তের কান্নার কাহিনীও।
ক্যারিয়ারের ‘শেষ’ বিশ্বকাপে কান্নাভেজা চোখে বিদায় নিলেন দুই মহাতারকা। শনিবার রাতে কাজান অ্যারেনায় নকআউট পর্বের প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে হার দেখে মেসির আর্জেন্টিনা। ফিস্ট অলিম্পিক স্টেডিয়ামে রোনালদোর পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে বাঁধভাঙা উল্লাসে মাতে সুয়ারেজ-কাভানির উরুগুয়ে। দুইটি গোলই করেন এডিনসন কাভানি। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লাইনআপও চূড়ান্ত হয়ে গেল। আগামী ৬ জুলাই নিঝনি নভগোরোদ স্টেডিয়ামে সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে উরুগুয়ে।
এক মেসিকে দিয়ে আর পার পাবে না আর্জেন্টিনা। ম্যাচের আগের দিন কোচ দিদিয়ের দেশমের এ ঘোষণা শনিবার কাজান অ্যারেনা স্টেডিয়ামে প্রমাণ করলেন তার দলের ফুটবলাররা। ৭ গোলের থ্রিলারে আর্জেন্টিনাকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে ১৯৯৮’র চ্যাম্পিয়নরা। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে দলকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন মেসি। এবার দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হলো মেসির আর্জেন্টিনাকে। আর এতে থেমে গেলো বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার লাখো সমর্থকের বিশ্বকাপ উন্মাদনা। কাজান অ্যারেনা স্টেডিয়ামের গ্যালারির প্রায় পুরোটাই পরিণত হয় শ্মশান ভূমিতে।
রুদ্ধশ্বাস ম্যাচের শেষ বাঁশির পর দীর্ঘক্ষণ মাঠের মাঝখানে বসে থাকে আর্জেন্টিনা দল। ফরাসী সমর্থকরা স্টেডিয়াম ছাড়লেও এ সময় দীর্ঘক্ষণ গ্যালারিতে অবস্থান করেন আর্জেন্টিনা সমর্থকরাও।
অথচ সবদিক দিয়ে এগিয়ে থেকে কাজানে ফ্রান্সের মুখোমুখি হয়েছিলে আর্জেন্টিনা। মাঠের ৪৫ হাজারের ৪০ হাজারই ছিলো তাদের সমর্থক। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে আর্জেন্টিনার অবস্থান ৫, ফ্রান্সের ৭। দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়েও এগিয়ে ছিলো তারা। এর আগে ১৩ বারের সাক্ষাতে আর্জেন্টিনা জিতেছে ৮টিতে, ফ্রান্স ২টিতে। ড্র হয়েছিলো ৩টি ম্যাচ। বিশ্বকাপে আগের দু’বারের লড়াইয়ে দু’বারই জিতেছে আর্জেন্টিনা। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে এক প্রীতি ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল ফ্রান্স। এরপর ফ্রান্সের বিপক্ষে দুই ম্যাচেই জিতেছে আর্জেন্টিনা। পরিসংখ্যানে এগিয়ে থেকে আন্ডারডগের মতো নকআউট পর্বের ম্যাচটি শুরু করে হোর্হে সাম্পাওলির শিষ্যরা। ম্যাচের দশম মিনিটেই ডি-বক্সের বাইরে মাসচেরানো গ্রিজম্যানকে অবৈধভাবে বাধা দিলে ফাউলের বাঁশি বাজান ইরানি রেফারী আলী রেজা ফাগানি। গ্রিজম্যানের ফ্রি-কিক ক্রসপিচে লেগে প্রতিহত হলে বড্ড বাঁচা বেচে যায় আর্জেন্টিনা। পরের মিনিটে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। এবার এমবাপেকে বক্সের মধ্যে ফেলে দেন মার্কোস রোহো। গ্রিজম্যানের নেয়া পেনাল্টিতে স্তম্ভ হয়ে যায় কাজানের গ্যালারি। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন হাজার হাজার আর্জেন্টাইন সমর্থক। মেসির মলিন মুখটাও তখন স্ক্রিনে ভেসে উঠছিলো। টিভি ক্যামেরা মনে হয় খুঁজে ফিরছিলো ম্যারাডোনাকে!
শুরু থেকেই আর্জেন্টিনা কেমন জানি খেলাটাই ধরতে পারছিলো না। মাঝমাঠে পেরেজ বানেগা ও মাসচেরানোকে একেবারে নিষ্প্রভ মনে হচ্ছিলো। মাঝ মাঠে বলের দখল না থাকায় মেসি, পাভন, ডি মারিয়াও বেকার সময় পার করছিলেন উপরিভাগে। উল্টো ডিফেন্ডারদের বাজে ডিফেন্ডিংয়ে একের পর এক গোল খাওয়ার শঙ্কা জাগে। ম্যাচের ১৯ মিনিটে আবারও এমবাপ্পেকে বক্সের ঠিক উপরে ফেলে দিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন তালিয়াফিকো। বিপজ্জনক স্থান থেকে পল পগবার নেয়া ফ্রি-কিক পোস্টের উপর দিয়ে চলে গেলে দ্বিতীয় গোলের হাত থেকে রক্ষা পায় দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। অপেক্ষায় তরুণ ফরাসি ফুটবলারদের স্পিডে ধরা খাচ্ছিলো মাসচেরানো ওটামেন্ডিরা। ম্যাচের প্রথম ৪০ মিনিটে পাভন, ডি মারিয়াকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিলো না। মেসি যাও দু’-একবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সতীর্থদের কারণে সফল হননি। যাকে জার্সি দেখে চিনতে হচ্ছিলো সেই ডি মারিয়ার কল্যাণেই সফলতা এসেছে ম্যাচের ৪২ মিনিটে। পাভনের নেয়া থ্রো থেকে নিজেদের মধ্যে বল দেয়া-নেয়া করে বক্সের প্রায় ৩০ গজ বাইরে থেকে আচমকা পোস্টে মারেন এই পিএসজি তারকা। তা থেকেই ম্যাচে সমতায় ফেরে আর্জেন্টিনা (১-১)। ঢেউ উঠে কাজানের গ্যালারিতে। যে ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো ভলগা নদীতে। থামতে দেননি মেসি-ডি মারিয়ারারা। বরং ঢেউএ আরও রং ছড়িয়েছেন বেশ কয়েক মিনিট।
সৌন্দর্যের শহর কাজান সকাল থেকে পরিণত হয়েছিলো মেসির শহরে। আর্জেন্টিনার বেশির ভাগ সমর্থকই কাজান এসেছে অন্য শহর থেকে। যে কারণে, সকাল থেকে দুপুর অবদি শহরে ছিল আর্জেন্টিনা সমর্থকদের দাপট। মস্কো থেকে কাজান আসা ট্রেনের যাত্রীদের তিনভাগের দুইভাগই ছিল আর্জেন্টিনার সমর্থক। দুপুরের পর আর্জেন্টিনা সমর্থকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে স্টেডিয়াম এলাকা। হাতে পতাকা ও ব্যানার, গায়ে জার্সি, মাথায় ক্যাপ। সেই সঙ্গে ঢাক-ঢোল। মেসি-ম্যারাডোনার নামে সংগীত নিয়ে তারা হাজির হয় স্টেডিয়ামে। তাদের সংগীতের তালে তালেই ম্যাচের ৪৮ মিনিটে দ্বিতীয় গোলের দেখা পায় আর্জেন্টিনা। বানেগার নেয়া ফ্রি-কিকে মেসির শট মার্কাদোর পায়ে লেগে আশ্রয় নেয় ফ্রান্সের জালে (২-১)। এই লিড বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দেননি আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডাররা। আবারও সেই ব্যাকপাস থেকে গোল হজম করতে বসেছিলো তারা। ফাজিওর ব্যাক পাস আগুয়ান গোলরক্ষক আরমানি বুঝতে উঠতে না পারায় তা প্রায় পেয়েই গিয়েছিলেন অ্যান্থনি গ্রিজম্যান। কিন্তু গ্রিজম্যানের শট অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে ম্যাচে তখন সমতায় ফেরা হয়নি ফরাসীদের। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষায় রাখেননি পাভার্ড। ডানদিক দিয়ে তার নেয়া অসাধারণ শটে সমতায় ফেরে ফ্রান্স (২-২)। এই গোলের রেস কাটতে না কাটতে এমবাপ্পে ম্যাজিক। ১৯ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের কল্যাণেই ম্যাচের ৬৪ মিনিটে আবারও লিড নেয় ফ্রান্স (৩-২)। পরপর দু’টি গোলই মাঝমাঠ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মেসি। আবারও এমবাপ্পে। এবার ডানদিক দিয়ে অলিভার জিরুর বাড়ানো বলে গোলরক্ষককে বোকা বানান এই পিএসজি তারকা (৪-২)। ইনজুরি সময়ে আরেক গোল ফেরত দেন সার্জিও আগুয়েরো।
এরপর যা হয়েছে তা শুধু কোটি কোটি আর্জেন্টাইন সমর্থদের হতাশাই বাড়িয়েছে। কান্নায় ভারি হয়ে গেছে কাজানের আকাশ বাতাস। যে কান্নার রেস গিয়ে আঁচড়ে পরেছে পুরো আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মাঝে। (মানবজমিন)