পি সি সরকারের যে জাদু আতঙ্কিত করেছিল ব্রিটিশদের
- প্রকাশের সময় : ১১:০৮:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ জুন ২০১৮
- / ১৫৮৬ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: হঠাৎ শত শত দর্শকের টেলিফোনে বিবিসির সুইচ বোর্ড কেঁপে উঠেছিল। সময়টা ছিল ১৯৫৬ সালের ৯ এপ্রিল রাত সোয়া ৯টা। যুক্তরাজ্যের এই দর্শকরা মনে করেছিলেন, তখনই তারা তাদের টেলিভিশনের পর্দায় ভয়াবহ খুনের ঘটনা সরাসরি দেখলেন। তারা ভড়কে গিয়েছিলেন। আতঙ্কিত হয়ে তারা টেলিফোন করছিলেন। বিবিসি গত সোমবার ()এ কথা জানায়।
ঘটনাটি ছিল, কসাইখানায় যেভাবে মাংস কাটা হয়, সে রকম একটি টেবিলে রাখা হয়েছে ১৭ বছর বয়সী এক তরুণীকে। আর রহস্যময় চেহারার এক জাদুকর টেবিলের ওপর ওই তরুণীর শরীর ধারাল ব্লেড দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে মাংস কাটছেন। এ পরিস্থিতি এমন একটা উত্তেজনা তৈরি করেছিল যে, কিছু একটা ভুল হয়েছে বলে মনে করেছিলেন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। কারণ জাদুকর এবং তার সহকারী ওই তরুণীকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। তরুণীর শরীর দ্বিখন্ডিত রেখেই জাদুকর তার মুখ এবং মাথা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। তখন উপস্থাপক রিচার্ড ডিম্বলবি ক্যামেরার সামনে এসে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। এর ফল যা দাঁড়িয়েছিল তাহলো আতঙ্কিত দর্শকদের টেলিফোনের ঝড় উঠেছিল। বিবিসি প্যানোরমা এই অনুষ্ঠানটি করেছিল। আর শ্বাসরুদ্ধকর সেই জাদু দেখাচ্ছিলেন ভারতের জাদুসম্রাট পি সি সরকার। পশ্চিমা দর্শকদের কাছে এই অনুষ্ঠানকে পি সি সরকারের জন্য একটা উত্থান বলা যায়। কারণ সে সময় লন্ডনের ডিউক অব ইয়র্ক থিয়েটার তিন সপ্তাহের জন্য ভাড়া নেয়া হয়েছিল পি সি সরকারের জাদু প্রদর্শনের জন্য। প্রথমে দর্শক পেতে তাকে বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু প্যানোরমার অনুষ্ঠানটি আলোড়ন সৃষ্টি করলে সেটি তার জন্য একটা বড় সুযোগ তৈরি করে দেয়। তিনিও সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। আকস্মিকভাবে উপস্থাপক যে মাঝপথে অনুষ্ঠান শেষ করে দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল যে, বরাদ্দ করা বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পিসি সরকার তার জাদু শেষ করতে পারেননি।
পর দিন লন্ডনে সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় খবর হয়েছিল যে, টিভি পর্দায় মর্মাহত করার মতো একজন তরুণীকে দ্বিখন্ডিত করার ঘটনা দেখানো হয়েছে। কিন্তু পি সি সরকারকে যারা চিনতেন, তারা জানতেন যে, তিনি সময় মেনে চলতেন। নির্ধারিত সময়ের বাইরে তিনি কোনোভাবে যেতেন না। তবে প্যানোরমা সেই অনুষ্ঠানের পর লন্ডনে পি সি সরকারের তিন সপ্তাহের শোর সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। পিসি সরকার ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার আশেকপুর গ্রামে তার জন্ম হয়। স্থানীয় শিবনাথ হাইস্কুলে তিনি পড়েছেন। তার বাবা ভগবান বন্দ্র সরকার এবং মা কুসুম কামিনী দেবী। দুই ভাইয়ের মধ্যে পি সি সরকার ছিলেন বড়। তার ছোট ভাই অতুল চন্দ্র সরকার। সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই জাদু বিদ্যায় তার আগ্রহ ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি জাদু দেখানো শুরু করেন। তখন খ্যাতিমান জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী তার গুরু ছিলেন। তবে জাদুর প্রতি আগ্রহ তার লেখাপড়ায় কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। তিনি ১৯৩৩ সালে তিনি গণিত শাস্ত্রে অনার্স পাস করে জাদুকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তার বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি বহু প্রাচীন জাদু খেলার মূল সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন।
পি সি সরকার বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেলেন কীভাবে? ভারত বা দক্ষিণ এশিয়া থেকে গিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করা বেশ কঠিন ছিল। পি সি সরকার অবস্থান করতে পেরেছিলেন তার কাজের মাধ্যমে। ব্রিটেনে জনপ্র্রিয়তা পাওয়ার অনেক আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেছিলেন। ১৯৫০ সালে তিনি আমেরিকান জাদুকর সোসাইটি এবং জাদুকরদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের আমন্ত্রণে শিকাগো গিয়েছিলেন জাদু দেখাতে। তখন থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ওয়াটার অব ইন্ডিয়া ছিল তার একটি জনপ্রিয় জাদু খেলা।এছাড়া তার আরেকটি জনপ্রিয় জাদু ছিল, একটি দ্রুতগামী ট্রেন আসার ৩৮ সেকেন্ড আগে তিনি হাতকড়া খুলে রেললাইন থেকে মুক্ত হয়ে আসেন। ১৭টি চাবি ব্যবহার করে হাতকড়া বন্ধ করে তাকে রেললাইনে রাখা হতো ট্রেন আসার আগে। এ ধরনের অনেক জাদু নিয়ে তিনি ৭০টির বেশি দেশে শো করেছেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে চিকিৎসক তাকে অতিরিক্ত ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে জাপান গিয়েছিলেন শো করতে। ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি পি সি সরকার জাপানে অনুষ্ঠান মঞ্চেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। (প্রতিদিনের সংবাদ)