ইউরোপ অভিবাসন প্রত্যাশীদের করুণ পরিণতি : ভূমধ্যসাগরে ৩৭ বাংলাদেশীর মৃত্যু
- প্রকাশের সময় : ০৩:২০:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০১৯
- / ৫৭১ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক: লিবিয়া থেকে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে প্রায় ৬০ জন অভিবাসী প্রাণ হারিয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশী। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশীর সংখ্যা ৩৭। তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট গত শনিবার (১১ মে) এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে এ পর্যন্ত ৬ বাংলাদেশী যুবকের পরিচয় জানা গেছে। তাদের বাড়ি সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায়। পরিচয় পাওয়া ছয় জনের মধ্যে চার জনেরই বাড়ি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়। তারা হচ্ছেন- উপজেলার সেনেরবাজার কটালপুর এলাকার মুহিদপুর গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে আহমদ হোসেন (২৪), একই গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে আব্দুল আজিজ (২৫), সিরাজ মিয়ার ছেলে লিটন মিয়া (২৪) ও মানিককোনা গ্রামের মৃত রফিক উদ্দিনের ছেলে আফজাল মোহাম্মদ (২৫)। অন্য দুজন হচ্ছেন- সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই কুলাউড়ার ভুকশিমাইলের আহসান হাবিব শামীম এবং তার শ্যালক গোলাপগঞ্জের শরীফগঞ্জ ইউনিয়নের কদুপুর গ্রামের ইয়াকুব আলীর ছোট ছেলে কামরান আহমদ মারুফ।
জানা গেছে, ইতালি যাওয়ার জন্য জন্য সিলেটের রাজা ম্যানশনের ইয়াহিয়া ওভারসীজ নামের একটি এজেন্সির সাথে ৮ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জের বেশকয়েকজন যুবক। জিন্দাবাজার রাজা ম্যানশনের তৃতীয় তলার ১১৭ নম্বর দোকান ইয়াহিয়া ওভারসীজ। এজেন্সির মালিক এনাম আহমদের বাড়িও ফেঞ্চুগঞ্জে। রোববার (১২ মে) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একাধিকবার গিয়েও এজেন্সির অফিস তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, প্রায় আড়াই বছর থেকে ইয়াহিয়া ওভারসীজ নামে ব্যবসা করছেন এনাম আহমদ। এর আগে অন্য একটি মার্কেটে তার অফিস ছিল।
উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের তথ্য অনুযায়ী, ইতালি অভিমুখী নৌকাটিতে ৫১ জন বাংলাদেশী ও তিনজন মিসরীয় ছাড়াও মরক্কো ও চাদের কয়েকজন ছিলেন। বাকিরা ছিলেন আফ্রিকান। উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একটি শিশুসহ মোট ১৪ জন বাংলাদেশী রয়েছে। সেই হিসাবে নৌকাডুবিতে মৃত্যু হয়েছে ৩৭ বাংলাদেশীর।
নৌকাডুবির পর উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্টকে জানায়, গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাতে লিবিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জুয়ারা উপকূল থেকে একটি বড় নৌকা ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। গভীর রাতে ভূমধ্যসাগরে তিউনিসিয়ার জলসীমায় ওই বড় নৌকা থেকে প্রায় ৭৫ জনকে ছোট একটি নৌকায় নামানো হয়। ওই ছোট নৌকাটি পরে ডুবে যায়।
তিউনিসিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর জারজিসে রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা মোনজি সিøম বলেন, ওই অভিবাসীদের বাতাসভর্তি ছোট একটি নৌকায় গাদাগাদি করে তোলার ১০ মিনিটের মধ্যে সেটি ডুবে যায়। তিউনিসিয়ার জেলেরা ১৬ জনকে উদ্ধার করে জারজিসের উপকূলে নিয়ে আসে।
উদ্ধার হওয়া অভিবাসীরা জানিয়েছে যে নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর থেকে তারা প্রায় আট ঘণ্টা ঠান্ডা পানিতে ভেসেছে। জেলেরা তাদের অবস্থান বুঝতে পেরে তিউনিসিয়ার কোস্ট গার্ডকে খবর দেয়।
এদিকে তিউনিসিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তিনজনের মরদেহ গত শুক্রবার (১০ মে) উদ্ধার করা হয়েছে।
মোনজি সিøম বলেন, যাদের উদ্ধার করা হয়েছে তাদের যদি তিউনিসিয়ার জেলেরা না দেখত তাহলে হয়তো তারা সাগরে ডুবেই মারা যেত। আর নৌকাডুবির বিষয়টি হয়তো কেউ জানতেই পারত না।
ভূমধ্যসাগর পথে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধারে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জাহাজ কাজ করে। তবে ইতালির সরকার এ ধরনের অভিযানের সমালোচনা করায় ওই জাহাজগুলোর তৎপরতাও কমে এসেছে।
ইতালির কট্টর ডানপন্থী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও স্যালভিনি ‘ক্লোড পোর্টস’ (বন্দর বন্ধ) নীতি অনুসরণ করছেন। তিনি সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া কোনো অভিবাসীকে তাঁর দেশে ঢুকতে দেবেন না বলে আগেই ঘোষণা করেছেন। তবে লিবিয়া থেকে যাত্রা করা দুটি নৌকা সমস্যায় পড়ায় গত শুক্রবার ৬০ জনেরও বেশি অভিবাসী ইতালিতে অবতরণ করার সুযোগ পেয়েছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ভূমধ্যসাগরকে বিশ্বের ভয়াবহতম পথ হিসেবে উল্লেখ করে আরো ট্র্যাজেডি এড়াতে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে। ইউএনএইচসিআরের ভূমধ্যসাগর বিষয়ক বিশেষ দূত ভিনসেন্ট কোচটেল বলেন, ওই অঞ্চলজুড়ে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম জোরদারে সক্ষমতা প্রয়োজন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘আমরা যদি এখনই উদ্যোগ না নিই তাহলে আগামী সপ্তাহ ও মাসগুলোতে এ ধরনের আরো মর্মান্তিক ঘটনা দেখতে হবে।’
ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা ক্রমেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। চলতি বছরের তিন মাসে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেনÑএমন অভিবাসীদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
২০১১ সালে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর সেখান থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লিবীয় ও অন্যান্য দেশের বাসিন্দা সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার জন্য ভূমধ্যসাগরকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত ১৭ হাজার অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে। এই যাত্রাপথে প্রায় ৫০০ অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ইউএনএইচসিআরের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানো অভিবাসীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সাগর পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে পারলেই যে অভিবাসীদের স্থায়ী আশ্রয় মিলবে এমন নয়। যারা ইউরোপে অবস্থানের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে না তাদের ফেরত পাঠানোর নীতি অনুসরণ করছে ইউরোপীয় দেশগুলো।