রোজার আগেই ক্রেতার নাভিশ্বাস
- প্রকাশের সময় : ০৮:০৩:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ১১১ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে এক মাসেরও কম সময় বাকি। এরই মধ্যে রোজায় সবচেয়ে ব্যবহূত ছয় পণ্যের মধ্যে পাঁচটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। গত এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে ছোলা, খেজুর, মসুর ডাল, চিনি ও পেঁয়াজ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।
মসলাজাতীয় পণ্যটি কেজিতে ২১৪ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
তবে এক বছরের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দাম ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এ ছাড়া বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মসলাজাতীয় পণ্য। বাজারে সব ধরনের পণ্যের মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতারা এমনিতেই চাপের মুখে রয়েছেন, এর মধ্যে আবশ্যক নিত্যপণ্যগুলোর মূল্য অস্বাভাবিক বাড়ায় তাঁদের এখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়।
সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার কারণ হিসেবে তদারকির অভাবকে দায়ী করেছেন বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এদিকে রোজার আগে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে চাল, চিনি, তেল ও খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে সরকার। গত ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এসব পণ্যের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও বাজারে এই চার পণ্যের দরের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।
এখনো আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে এগুলো। বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর শুল্ক কমানোর সুবিধা আমদানিকারকরা পেলেও ভোক্তাদের কাছে সেই সুবিধা পৌঁছায় না। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
ভোক্তারা বলছেন, প্রতিবছর নানা অজুহাতে রোজার আগে আগে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এবারও তাই হচ্ছে। এদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকট এবং ঋণপত্র খোলা (এলসি) নিয়ে জটিলতার কারণে এবার পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ছোলা, ভোজ্য তেল, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর—এই আট পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত নগদ মার্জিন ন্যূনতম রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রমজানে ভোগ্য পণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমদানি সহজ করতে সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ।
বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধারণত প্রতিবছরই রমজান শুরুর এক-দুই সপ্তাহ আগেই পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে সরকারের দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থার অভিযান শুরু হয়। মূলত সেই বিষয়টি মাথায় রেখে এক থেকে দেড় মাস আগেই রোজার পণ্যগুলোর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সরবরাহ সংকট দেখিয়ে বাজার যাতে অস্থিতিশীল না হয়ে ওঠে, সে জন্য এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এই সুযোগের ফলে বাকিতে পণ্য আমদানি করা যাবে। এখন ব্যাংকগুলো যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে আমদানির এলসি খুললে পণ্য সময়মতো চলে আসবে। এতে রমজান উপলক্ষে প্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হবে।
জানতে চাইলে ছোলা ও ডাল আমদানিকারক এবং বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের বাড়তি দামের কারণে এখন ভারত থেকে ছোলা আমদানিতে খরচ বেশি পড়ছে। সরকার আমাদের চাপ দিচ্ছে দাম কমিয়ে বিক্রি করতে, কিন্তু এখন কিভাবে ছোলার দাম কমিয়ে বিক্রি করব।’
শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে রোজার পণ্যগুলোর চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। তাই আমদানি বাড়ানো না গেলে বাজারে পণ্যের দাম কমবে না। ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত দরে পর্যাপ্ত ডলার পেলে প্রচুর পণ্য আমদানি করবেন। এতে বাজারে বাড়বে পণ্যের সরবরাহ, বাজারও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ভোক্তারাও কম দামে রমজানে পণ্য কিনতে পারবেন।’
জানতে চাইলে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবছর রোজার আগে পণ্যের দাম বাড়ে, তখন আমদানিকারকরা বাজারে পণ্যের দাম কমার কথা বলে শুল্ক কমাতে অনুরোধ করেন। এবারও নানা অজুুহাতে শুল্ক কমিয়েছেন ব্যবসায়ীরা, কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে এর কোনো সুফল আসছে না। তাই আমদানিকারক, উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। এতে জবাবদিহিও নিশ্চিত হবে বলে তিনি জানান।
চলতি অর্থবছরে অতিরিক্ত শুল্ক-কর আরোপ করায় খেজুরের বাজার অস্থির বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। দেশে বছরে প্রায় ৫০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে, যার পুরোটা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আমদানি করা হয়।
রাজধানীর পাইকারি ফলের বাজার বাদামতলীর মোল্লা ফ্রেশ ফ্রুটসের ব্যবসায়ী ও ফল আমদানিকারক মো. আল-আমিন মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খেজুর আমদানিতে শুল্ক ব্যাপক হারে বৃদ্ধি, ডলারের সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ও এলসি খোলায় জটিলতার কারণে বেড়েছে আমদানি ব্যয়। ফলে এবার দেশের বাজারে খেজুরের দাম বাড়তি। বাড়তি শুল্ক দিয়েও ব্যবসায়ীরা এবার খেজুর আমদানি করতে পারেননি। যার কারণে চাহিদার তুলনায় বাজারে খেজুরের সরবরাহ কম। দেশের বাজারে খেজুরের সরবরাহ বাড়াতে শুল্ক আরো কমিয়ে ব্যবসায়ীদের খেজুর আমদানির সুযোগ দিতে হবে। তাহলে অনেকটাই কম দামে ভোক্তারা খেজুর কিনতে পারবেন।’
জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার শুল্ক কমিয়েছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা যদি চাহিদামতো এলসি খুলতে না পারেন, তাহলে তো শুল্কের সুফল পাওয়া যাবে না। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে সরকারকে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো গেলে শুল্কের সুফল তখন ভোক্তারা পাবেন।’
তিনি বলেন, ‘এবার ডলারের যে কিছুটা সংকট রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সরকারের দায়িত্বরত মন্ত্রীরা বলছেন রোজার প্রধান পণ্যগুলো যাতে পর্যাপ্ত আমদানি হয়, তাতে তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করছেন এবং করবেন।’
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বাজারদর এবং গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ছোলার দাম গত এক বছরের ব্যবধানে ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে খুচরায় কেজি মানভেদে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ কেজিতে ২০০ থেকে ২১৪ শতাংশ দাম বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে ১৩০ টাকা কেজিতেও পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ১১ থেকে ১২ শতাংশ দাম বেড়ে ছোট দানার দেশি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়।
এক বছরের ব্যবধানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়েনি, ১০ শতাংশ দাম কমে প্রতি লিটার ১৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বছরব্যাপী অস্থির ছিল চিনির বাজার। মাঝে বাড়তি দাম দিয়েও ক্রেতারা চিনি কিনতে পারেননি। এক বছরের ব্যবধানে খোলা চিনি কেজিতে ১৭ থেকে ২২ শতাংশ দাম বেড়ে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উচ্চ শুল্কায়নের কারণে বাজারে খেজুরের দাম অনেকটাই বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। সাধারণমানের খেজুর প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ দাম বেড়ে ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তবে কিছুটা ভালোমানের খেজুর আজোয়া ও মরিয়ম মানভেদে কেজি ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন সুপার শপে উন্নতমানের খেজুর চার হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি করতে দেখা গেছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘রোজাকে কেন্দ্র করে বাজারে কারসাজি রোধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। শুল্ক কমানো দরকার ছিল অন্তত এক মাস আগে। এখন নতুন শুল্কের আওতায় আমদানি হওয়া পণ্য বাজারে আসতে কিছুটা সময় লাগবে। তা ছাড়া শুল্ক যে পরিমাণে কমানো হয়েছে, তাতে বাজারে কতটা প্রভাব পড়তে পারে, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।’
গতকাল চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময়সভায় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু হুঁশিয়ারি দেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে আমদানিকারক যত শক্তিশালীই হোন, সেই মিলের গেট ও সংশ্লিষ্ট দোকান বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমে তিন বছরে সর্বনিম্ন হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে বিশ্ববাজারে গম, ভুট্টা, মাংসসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমেছে। যা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে সর্বনিম্ন। সংস্থা জানায়, গত মাসে খাদ্যপণ্যের সূচক কমে হয় ১১৮ পয়েন্ট। যা আগের মাসের ১১৯.১ পয়েন্ট থেকে ১ শতাংশ কম এবং এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ১০.৪ শতাংশ কম। সূত্র : কালের কণ্ঠ
হককথা/নাছরিন