রাজস্ব, ভর্তুকি, মূল্যস্ফীতি: আগামী অর্থবছরে সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ
- প্রকাশের সময় : ১০:২০:২৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ জুন ২০২৪
- / ৭৪ বার পঠিত
রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারে বকেয়া ভর্তুকি সামলানো এবং আমদানি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় আগামী অর্থবছরকে চ্যালেঞ্জিং হিসেবে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি কৌশল প্রস্তাব করেছে। তার মধ্যে রয়েছে ধীরে ধীরে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাজার-ভিত্তিক ব্যবস্থায় স্থানান্তরিত করা এবং বকেয়া ভর্তুকি কমিয়ে আনতে সীমিত পর্যায়ে কৃচ্ছ্রসাধন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা।
এটি অটোমেশনের মাধ্যমে কর প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি, আয়কর ও মূল্য সংযোজন করের আওতা বাড়ানো এবং ক্রমান্বয়ে কর রেয়াত হ্রাস করারও প্রস্তাব করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, ১৩ মে অর্থ বিভাগ এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করে এবং এগুলো মোকাবিলায় বিভিন্ন করণীয় উপস্থাপন করে।
মন্ত্রণালয়ের উল্লেখ করা অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে তহবিলের ঘাটতির কারণে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পে বিলম্ব এবং বিনিয়োগ বাড়াতে নীতি-সংস্কার ও ব্যবসার পরিস্থিতি উন্নয়ন। আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি করা এবং বিনিময় হার পরিচালনা করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে মন্ত্রণালয় বৈঠকে এসব ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেনি।
মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত করা চ্যালেঞ্জগুলোকে ‘যথার্থ’ হিসেবে উল্লেখ করে অর্থ বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয় রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং বিনিময় হারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা এড়িয়ে যাচ্ছে কারণ এগুলো মন্ত্রণালয় থেকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব।’
‘যদিও মন্ত্রণালয় আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির কথা উল্লেখ করেছে, তবে এটা স্বীকার করা গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্তমান মূল্যস্ফীতির পেছনে অনেক অভ্যন্তরীণ কারণও রয়েছে। মূল্যস্ফীতি কার্যকরভাবে পরিচালনা করার জন্য এসব কারণ চিহ্নিত করা এবং ব্যবস্থা নেওয়া দরকার,’ তিনি বলেন।
‘সরকার একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি ও ভর্তুকি উভয়ই কমাতে চায়। তবে ভর্তুকি কমানো মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, তাই ভর্তুকি ধীরে ধীরে হ্রাস করা দরকার,’ তিনি ব্যাখ্যা করেন। কৃচ্ছ্রসাধন নীতি সহজ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘায়িত কৃচ্ছ্রতা অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদা হ্রাস করতে পারে। যার ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমাসহ প্রতিকূল অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি হতে পারে।’
ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে কমানো হবে- মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে এক সভায় সরকার প্রতি তিন মাসে ক্রমান্বয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং ধীরে ধীরে জ্বালানি ভর্তুকি কমাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের বকেয়া ভর্তুকি ৭০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। এ মধ্যে শুধু বিদ্যুৎ ভর্তুকি মোট ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই বকেয়া মেটাতে সরকার আগামী অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তহবিল বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে।
২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি এবং প্রণোদনার জন্য এক লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগামী ২০২৪–২৫ অর্খবছরের বাজেটে এ বরাদ্দ এক লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী অর্থবছরের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্ব আহরণ বাড়ানো। তিনি বলেন, অর্থনীতির বিদ্যমান অসুবিধা মোকাবিলায় আসন্ন বাজেটে বিভিন্ন পদক্ষেপে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়। তবে এর কোনোটিই পূরণ হচ্ছে না। সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশে সমন্বয় করা এবং রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে চার লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকায় করা হলেও তা অর্জন সম্ভবপর হবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার এবং পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণকে বেশ চ্যালেঞ্জিং হিসাবে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সহজ করা হতে পারে কৃচ্ছ্রসাধন- রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত সফলতা না পাওয়ায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকেই অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে তিন বছরব্যাপী চলমান এ কঠোর ব্যয়সাশ্রয়ী নীতি থেকে সরকার ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে নতুন অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপিত নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে সীমিত আকারে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের।
এডিপি অর্থায়ন আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ- ভর্তুকি এবং ঋণের সুদ পরিশোধের মতো ক্রমবর্ধমান খরচ ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বরাদ্দকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আগামী অর্থবছরের প্রায় সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে এডিপি বরাদ্দ মাত্র দুই হাজার কোটি টাকা বেড়ে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে। এ অবস্থায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকির চাহিদা মিটিয়ে এডিপিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সঞ্চালন করা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটেও এডিপির আকার ২০ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয় কর প্রশাসনের দক্ষতা এবং স্বয়ংক্রিয়তা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। এছাড়া আয়কর এবং মূল্য সংযোজন করের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি কর রেয়াতও পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে চায় সরকার। অর্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভর্তুকি ও প্রণোদনা ছাড়াও আগামী অর্থবছরে সরকারি ঋণের সুদব্যয় মেটাতে এক লাখ আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা এবং সরকারি চাকরিজীবীধের বেতনভাতার জন্যও বরাদ্দ বাড়বে। এসব ব্যয় কমানোর কোনো সুযোগ থাকছে না। তাই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে সরকার হয় এডিপিতে অর্থ সঞ্চালন কমাবে অথবা উচ্চ হারে ঋণ নিতে বাধ্য হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্থর অগ্রগতি, বিশেষ করে এ দুটি খাতের বৈদেশিক অর্থায়ন হ্রাসকে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এডিপি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য আগামী অর্থবছরে মনিটরিং জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
বিনিয়োগ বাড়াতে নীতি-সংস্কার জরুরি- উচ্চ পর্যায়ের দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নীতি-সংস্কার এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি আসন্ন অর্থবছরের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি প্রকাশিত জিডিপির সাময়িক হিসাব অনুসারে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অর্থ কর্মকর্তারা বলেছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হয়েছিল জিডিপির ২৬ শতাংশ। তবে এটি সাড়ে ২৪ শতাংশ হতে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তা সম্প্রসারণে অগ্রাধিকার- আগামী অর্থবছরে সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার পরিধি বিস্তৃত করার দিকে জোর দেবে। অধিক সংখ্যক জনগণকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনা গেলে এক দশক পর থেকে ধীরে ধীরে বয়স্ক ভাতায় সরকারের ব্যয় কমে যাবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। রয়েছে গভীর চ্যালেঞ্জও- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বর্ণিত চ্যালেঞ্জ এবং কৌশলগুলো সঠিক হলেও কিছু গভীর চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার এবং কর প্রশাসনের পুনর্গঠনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরা উচিত ছিল।
‘ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ব্যর্থতা শুধু বেসরকারি খাতই নয়, সরকারের বাজেট বাস্তবায়নেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ব্যাংকিং খাত বাজেটকে প্রতিফলিত করে। কারণ এটি সরকারি ঋণ এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের সুদ, সেইসঙ্গে রাজস্ব আহরণকে প্রভাবিত করে,’ বলেন তিনি।’বর্তমান কর প্রশাসন দিয়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা যায়নি। সার্কেল-ভিত্তিক অপারেশন থেকে উত্তরণে একটি আধুনিক কর প্রশাসন প্রয়োজন। এর জন্য কর-নীতি এবং কর প্রশাসনের পৃথকীকরণ প্রয়োজন। কিন্তু এতে নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে ভেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এটির বিরোধিতা করে,’ বলেন আহসান মনসুর।
স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সরকারি নীতি সংশোধনের আশু প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে।’