লোহিত সাগর সংঘাতে প্রকট বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি
- প্রকাশের সময় : ০৪:৫১:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৪
- / ৯২ বার পঠিত
হককথা ডেস্ক : লোহিত সাগরে ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন হুতি বিদ্রোহীদের ইসরায়েলবিরোধী অভিযান এবং দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের আগ্রাসী হামলা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অদূর ভবিষ্যতে বড় প্রভাব রাখতে যাচ্ছে। কফি থেকে ফলসহ বিভিন্ন পণ্যের চালান ব্যাহত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছিল এ বছর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এর বিপরীত চিত্রকেই প্রকট করে তুলছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যাপকহারে বাড়বে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও- এমনটাই মতামত বিশেষজ্ঞদের।
ভূ-রাজনীতি ও অর্থনীতিতে লোহিত সাগর এ সময়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক পটভূমি। বৈশ্বিক বাণিজ্যের ১২-১৫ শতাংশ পণ্যবাহী জাহাজ লোহিত সাগর দিয়ে চলাচল করে। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসনের প্রতিবাদে এ পথে চলা পণ্যবাহী জাহাজে হামলা চালিয়েছে হুতি বিদ্রোহীরা। ইয়েমেনে হুতিদের দমন করতে পাল্টাহামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের যৌথ বাহিনী। এ তিন কারণে গুরুত্বপূর্ণ এ বাণিজ্য পথে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারখানায় উপকরণ সংকট দেখা দিয়েছে এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্লেষকরা জানান, বাব আল-মান্দেব প্রণালি (২০ মাইল প্রশস্ত চ্যানেল) ইয়েমেন ও আফ্রিকার ইরিত্রিয়া ও জিবুতিকে বিভক্ত করেছে। গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর ইরান-সমর্থিত হুতিরা লোহিত সাগরে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে হামলা শুরু করে। এরপর শিপিং জায়ান্টরা লোহিত সাগর দিয়ে পণ্য পরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেয়।
ব্রিটিশ সমুদ্র নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান অ্যামব্রেয়ের মতে, চলতি সপ্তাহে পশ্চিমা বাহিনীর হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও হামলা অব্যাহত। ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূলে একটি যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন পণ্যবাহী জাহাজ আক্রান্ত হয়েছে। প্রধান শিপিং সংস্থাগুলো এখন আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে তাদের জাহাজগুলোকে পরিচালনা করছে। এতে সিঙ্গাপুর ও উত্তর ইউরোপের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে ১২ দিন অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। শিপিং জায়ান্ট হ্যাপাগ-লয়েডের মতে, সিঙ্গাপুর থেকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যাতায়াতকারী জাহাজের জন্য অতিরিক্ত ১৮ দিন যোগ করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ, জাহাজ ভাড়া ও কর্মীদের বেতন।
বিবিসি বলছে, কোভিড-১৯ মহামারি এবং এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সে মূল্যস্ফীতিও বিভিন্ন দেশে কমতে শুরু করেছে। তবে লোহিত সাগরের অনিশ্চয়তা নতুন করে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে তেল ও খাদ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্যসামগ্রী বোঝাই জাহাজগুলো আফ্রিকার চারপাশে দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়েই হুতিদের আক্রমণ এড়াতে পারে; কিন্তু গ্যাস, তেল এবং ভোগ্যপণ্যের কার্গোর বিপরীতে অন্যান্য পচনশীল খাবার বহনকারী কার্গোর সময় বেশি লাগার কারণে পণ্যগুলো বিক্রির অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
এটি খাদ্য আমদানি-রপ্তানি খাতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতালীয় রপ্তানিকারকরা আশঙ্কা করছেন, এই পথে চলাচল করার জন্য কিউই এবং সিট্রাস জাতীয় ফল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, চীনা আদার দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং কিছু আফ্রিকান কফি বহনকারী কার্গো গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে। সুয়েজ খাল থেকে শস্য বহনকারী কার্গো জাহাজগুলো সরানো হচ্ছে এবং পশুসম্পদ বহনকারী কার্গোগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য পথ পরিবর্তন করছে।
পণ্যের ওপর এই প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা আরও ভঙ্গুর হতে পারে। সমস্যা আরও তীব্র হলে খাদ্যপণ্যের মূল্য আরও বাড়বে। ভারতীয় প্রধান আঙুর রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইউরো ফ্রুটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিতিন আগরওয়াল বলেন, ‘এখানে সবারই ক্ষতি হয়েছে। লোহিত সাগর এড়িয়ে দীর্ঘ রুট ব্যবহার করার কারণে পণ্য পরিবহন খরচ চারগুণ এবং ট্রানজিট সময় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’ এর ফলে আঙুরের গুণগতমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বেশিরভাগ ইউরোপীয় আমদানিকারক ভারতীয় আঙুর উচ্চ মূল্যে ক্রয় করতে সম্মত হয়েছে, যা ভোক্তাদের খরচ আরও বাড়াবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাধারণত আঙুরের চাহিদার প্রায় এক-সপ্তমাংশ ভারত থেকে আমদানি করে এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে এই চাহিদা ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ইতালীয় রপ্তানিকারকরা এশিয়ায় প্রায় ৪.৪ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের কৃষি পণ্য বিক্রি করে। ফার্ম গ্রুপ কনফ্যাগ্রিকোল্টুরার প্রেসিডেন্ট ম্যাসিমিলিয়ানো জিয়ানসান্টি বলেছেন, ‘এর ফলে আপেল, কিউই এবং সিট্রাস জাতীয় ফলের খরচ বাড়বে।’ এটি কৃষকদের জন্যও চিন্তার কারণ যেহেতু উচ্চ শিপিং খরচ মেটাতে তাদের দাম কমাতে হতে পারে।
কৃষি-খাদ্য ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করা সিইএলসিএ-এর তথ্যমতে, শিপিং সমস্যার কারণে ইউরোপে শূকরের মাংস, দুগ্ধ এবং ওয়াইনের মতো পণ্যের রপ্তানির পাশাপাশি চা, মসলা এবং হাঁস-মুরগির আমদানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও এর প্রভাব কেমন হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। সুয়েজ খালের দিকে রওনা হওয়া প্রায় ১.৬ মিলিয়ন টন শস্য বহনকারী জাহাজ সাম্প্রতিক সপ্তাহে অন্য রুটে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর বেশিরভাগই চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ফসল নিয়ে যাচ্ছিল।
সুয়েজ খাল হয়ে ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরকে এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছে লোহিত সাগর। বর্তমানে বিশ্বের ১২ শতাংশ পণ্যবাহী জাহাজ লোহিত সাগর ব্যবহার করে। দৈনিক গড়ে ৫০টি জাহাজ ব্যবহার করছে এই জলপথ। এসব জাহাজে ৩০০ থেকে ৯০০ বিলিয়ন ডলারের কার্গো পরিবহন করা হয়। প্রতিবছর এই রুট ব্যবহার করে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য পরিবহন করা হয়। ক্লার্কসন রিসার্চ সার্ভিস লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল ডিসেম্বরের প্রথমার্ধের তুলনায় ৪৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এ ছাড়া বন্দরে পৌঁছাতে উত্তমাশা অন্তরীপের আশপাশের জলসীমা ব্যবহারকারী জাহাজের সংখ্যাও বেড়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি ও মানবসম্পদের ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে বেড়ে গেছে বীমা খরচ। এ কারণে পণ্যবাহী জাহাজ পৌঁছাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরি হতে পারে। পাশাপাশি বন্দরগুলোতে কনটেইনারের জটও বেড়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যকার আটটি প্রধান রুটে চলাচলকারী পণ্যবাহী জাহাজের হিসাব রাখে ড্রেউরি ওয়ার্ল্ড কনটেইনার। তাদের সূচক অনুযায়ী, চীন থেকে ইউরোপে ৪০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার পাঠানোর খরচ ২৪৮ শতাংশ বেড়েছে। নভেম্বরে যখন হামলা হয়, তখন একই কনটেইনার পাঠাতে খরচ পড়ত এক হাজার ১৪৮ ডলার।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ অনেক দেশ এ অঞ্চলে থাকায় বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আবার বেড়ে যেতে পারে। সৌদি জ্বালানি তেল জায়ান্ট আরামকোর সিইও আমিন নাসের জানিয়েছেন, হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে হামলা শুরুর পর বাব আল মান্দেব প্রণালি এড়িয়ে চলছে আরামকো। এ কারণে জ্বালানি তেল গন্তব্যে পৌঁছতে অতিরিক্ত সময় লাগছে। এটা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলে কোনো সমস্যা ছিল না। এটা যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি, ফলে সমস্যা ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করছে। দূরের যাত্রায় চলাচল করার জন্য আরও বেশি ট্যাংকার প্রয়োজন হচ্ছে।
লোহিত সাগরে সংকট কীভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে হতাশ বিভিন্ন দেশের বেসরকারি খাতের শীর্ষ নির্বাহীরা। শিপিং জায়ান্ট মায়ের্স্কের সিইও ভিনসেন্ট ক্লার্ক জানিয়েছেন, ‘বৈশ্বিক শিপিং চলাচল আরও কয়েক মাস ব্যাহত হতে পারে। এই সংকট যত দীর্ঘায়িত হবে পরিবহন খরচ তত বাড়তে থাকবে।’ সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে ইউবিএসের সিইও সার্জিও এরমতি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমে আসায় আর্থিক বাজারে এক ধরনের পরিতৃপ্তি ছিল। কিন্তু লোহিত সাগরে হুতিদের হামলার কারণে জাহাজ পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা প্রকারান্তরে পণ্যের দাম বাড়াবে।’
কেমব্রিজের কুইন্স কলেজের সভাপতি এবং আর্থিক সেবা জায়ান্ট অ্যালিয়ানজের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ডক্টর এল-এরিয়ান বলেন, ‘পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মর্টগেজ সুদের উচ্চ হার এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধি দেখতে পাব। তবে এটা ২০২১ ও ২০২২ সালে যা ঘটেছে তার তুলনায় কিছুই নয়। ধাক্কাটি ততটা বড় হবে না। তবে যা ঘটছে তা হতাশাজনক।’ সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল
হককথা/নাছরিন