সব পণ্যেই সিন্ডিকেট
- প্রকাশের সময় : ১১:৩৭:০১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৬৫ বার পঠিত
চলতি বছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী। দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে উঠেছে। অক্টোবরের পর এটিই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ জীবনযাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আসন্ন রমজান মাসকে ঘিরে প্রয়োজনীয় সব নিত্যপণ্য নিয়ে চলছে কারসাজি। রমজান মাস আসার আগেই ব্যবসায়ীদের ‘রোজার ব্যবসা’ এখনই শুরু হয়ে গেছে। দেশে সরবরাহ সংকট না থাকলেও কিছু অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ রমজানকে সামনে রেখে অল্প সময়ে বাড়তি মুনাফা তুলে নিতে নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এবার আগেভাগে কঠোর অবস্থানে থাকলেও দাম কমছে না। এর পেছনে ঘুরেফিরে বারবার সিন্ডিকেটের বিষয় আলোচনায় উঠে আসছে। মূল্য নির্ধারণ, আমদানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদান, তদারকি অভিযান এবং জরিমানা করার পরও সিন্ডিকেটের খপ্পর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না ভোক্তা। আসছে রোজায় আরও খরচ বাড়ার দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে চাল, ডাল, ছোলা, অ্যাংকর, পাম তেল, পেঁয়াজ, খেজুর, ডিম, মুরগি, গরুর মাংসসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এক মাসের ব্যবধানেই পেঁয়াজের দাম ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ছোলা প্রায় ১১ শতাংশ, মসুর প্রায় ২ শতাংশ, পাম তেল ২ শতাংশ, চাল দেড় শতাংশ, খেজুর ৫৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, ডিম ৭ শতাংশ ও গরুর মাংসের দাম প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়েছে। টিসিবির তালিকায় না থাকলেও রোজা উপলক্ষে সামান্য চিড়া-মুড়ির দামটাও লাফিয়ে বাড়ছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোজা ঘিরে দুই মাস আগে থেকেই পণ্যের অতিরিক্ত মজুদ করছেন অসংখ্য ব্যবসায়ী। এতে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
২৪ জানুয়ারি নওগাঁর মান্দায় পরাণপুর ইউনিয়নের সোনাপুর ও কালীতলা বাজারে উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালালে এক ব্যবসায়ীর দুই গুদামে বিপুল পরিমাণ নিত্যপন্যের অবৈধ মজুদ বেরিয়ে আসে। আসন্ন রমজান সামনে রেখে মাসুদ এন্টারপ্রাইজ নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি দুটি গোডাউনে হাজার হাজার কেজি চিনি, বুট, মুড়ি, ডাল, গম, আটা, ময়দা এবং সয়াবিন, পাম ও সরিষা তেল মজুদ করে। বাদ পড়েনি লবণও। এদিকে দেশের বিভিন্ন জেলায় পরিচালিত অভিযানে চালিয়ে চালের অবৈধ মজুদ ও বিক্রিতে নানা অনিয়ম ধরা পড়ছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার বারবার মজুদদারদের সতর্ক করছেন। দাম কমানোর জন্য মিল মালিকদের অনুরোধও করেছেন; কিন্তু দাম আশানুরূপ কমেনি।
চালকল মালিকদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং মিল মালিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি লায়েক আলী বলেন, মৌসুমের থেকে এবার ধানের দাম বেশি। তাই দাম বাড়তি। আমরা নিরুপায়। তার পরও দাম কমাতে মিলাররা চেষ্টা করছেন। কৃষকদের কাছ থেকে অনেক কমে কেনা আলু বেশি দামে বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিয়েছে মজুদদাররা। বর্তমানে পণ্যটির দাম কমেছে। কিন্তু একই কায়দায় পেঁয়াজে কারসাজি চলছে। মৌসুমে এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকা পর্যন্ত। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজ এবার আগেভাগে ফুরিয়ে গেছে।
দীর্ঘসময় পর কয়েকজন ব্যবসায়ীর উদ্যোগে কমতে শুরু করেছিল গরুর মাংসের দাম। দাম কমে ৫৯০ টাকায় নেমে আসা পণ্যটির দাম মাঝে ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করতে বাধ্য হয় মাংস বিক্রেতারা। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রের দাপটে এ দাম বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এক মাসের মধ্যেই তা বেড়ে আবারও ৭৫০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মাংসের বাজারে সিন্ডিকেট এতটাই সক্রিয় যে, কম দামে বিক্রয়কারীদের হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় কম দামে বিক্রি করা আলোচিত মাংস বিক্রেতা মো. খলিল বলেন, কম দামে বিক্রি করায় হত্যার হুমকি পেতে হয়েছে আমাকে। যদিও এখন তা বন্ধ হয়েছে। মাংসের দাম আমাকেও বাড়াতে হয়েছে। এখন ৬৯৫ টাকা কেজি বিক্রি করছি। এর চেয়ে কমে বিক্রি করা যাচ্ছে না। অন্যরা ৭৫০ টাকা বিক্রি করছেন।
এদিকে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজারেও কম কাণ্ড ঘটেনি। শেষমেশ আমদানির অনুমতির পর ডিমের দাম কমে আসে। পোল্ট্রি খাতে কারসাজিকারী নেপথ্যে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য প্রকাশ পায়। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মামলাও হয়েছে। কিন্তু এর পরও কারসাজি থেমে নেই বলে জানান খাতসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, এ খাতে কিছুই বদলায়নি। ডিম, মুরগি ও একদিনের বাচ্চার বাজার সম্পূর্ণ করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি পোল্ট্রি ফিডও। তারাই মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজার ব্যবস্থপনায় ত্রুটির সুযোগ নিয়ে অসাধু চক্রগুলো একই কায়দায় প্রতিবার অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিচ্ছে। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক হলেও ভোক্তাপর্যায় পর্যন্ত তার সুফল পৌঁছাচ্ছে না। তদারকি, অভিযান, জরিমানায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বড়রা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। চাহিদা-জোগানের সূত্র মেনে নয়, প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্রগুলোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্র্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের এখানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বড় ঘাটতি রয়েছে। বাজারে নতুনদের প্রবেশ সহজ করতে হবে। অথচ আমাদের এখানে সামান্য ট্রেড লাইসেন্স পেতেই ঘাম ছুটে যায়। আবার ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে সরকার বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে। সরকার রাজস্ব হারিয়ে এ সুবিধাগুলো দেওয়া হলেও কেবল ব্যবসায়ীরা তা ভোগ করে। মোবাইল কোর্ট কাজে আসছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব অভিযানে ছোটরাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানও মনে করেন, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় সমাধান মিলছে না। অপরাধ করে বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা সংক্রমিত হয়েছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ‘লোভস্ফীতিও’ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তিনি সরবরাহ ঠিক রাখতে প্রয়োজনে সরকারকে সরাসরি পণ্য আমদানি এবং দরিদ্রদের মধ্যে ভর্ভুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান-জরিমানা নয় বরং তথ্য-উপাত্তের মনিটরিং বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, মোবাইল কোর্ট-জরিমানা এগুলো মনিটরিং না। এগুলো কাজে আসে না। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা যে পরিসংখ্যানগুলো পাই সেগুলোতে ত্রুটি আছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে সন্তুষ্ট করতে বেশি বেশি দেখানো হয়। তিনি বলেন, পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের তথ্য-উপাত্তে নিবিড় নজরদারিই হচ্ছে প্রকৃত মনিটরিং। সূত্র : আমাদের সময়।