নিউইয়র্ক: ‘মা’ ছোট্ট কিন্তু মধুর একটি শব্দ। এর সমার্থক, সমকক্ষ বা তুলনীয় কিছুই এই পৃথিবীতে নেই। ছোট্ট একটা শিশু যখন পৃথিবীতে আসে, তখন সে তার আশপাশের কোন কিছুকেই জানে না চেনে না। কিন্তু তার মাকে সে ঠিকই চিনে নেয়। মা’ই তখন তার পৃথিবী। একজন মমতাময়ী মা প্রসবকালীন মৃত্যু যন্ত্রণা মুহূর্তেই ভুলে যায় ছোট্টমণির মুখটি দেখে। কি আজব ব্যাপার। কয়েক মুহূর্ত আগেই যে মা মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করছিল- অথচ শিশু ভুমিষ্ট হওয়ার পর সবকিছু ভুলে অনাবিল এক সুখ ও শান্তিমাখা হাসি ফুটে উঠে সেই মায়ের মুখে। এ যেন ঐশ^রিক ব্যাপার। এটাই সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠত্বকে প্রকাশের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একজন মায়ের সাথে তার সন্তানের চিরকালীন মমত্বের বন্ধন। এই নশ^র পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কোটি কোটি নিয়ামতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো ‘মা’। একজন মধ্যবয়সী মানুষ রোগ যন্ত্রণায়, মুমূর্ষ অবস্থায় অচেতনভাবে মা-মা-মা বলে ডাকতে থাকে। কারণ এই ‘মা’ ডাকের মধ্যেই সে শান্তি খুঁজে পায়। আর পৃথিবীর বড় বড় ডাক্তারদের চিকিৎসার চাইতেও সেই মুহূর্তে ‘মা’ নামের অমিয় সুধাই সেই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি দেয়, শান্তি দেয়। এটা কোন বানানো কথা নয়- কোটি কোটি সন্তানের সরল স্বীকারোক্তি। শত বিপদের মুখেও মায়ের নিষ্পাপ মুখটি কোন সন্তান যদি স্মরণ করে, মাকে ডাকে- মায়ের দো’য়ায় কেটে যায় তার বিপদ। এমনই গুরুত্বপূর্ণ সন্তানের জীবনে তার ‘মা’। তাই তো কবি লিখেছেন- ‘মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই/ মায়ের চেয়ে নামটি মধুর তিন ভূবনে নাই’।
মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সর্বশেষ নবী, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তাফা (স.)-এর একটি হাদিস থেকে জানা যায়- একদিন প্রিয় নবী নামাজের পরে তাঁর সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে বসে আছেন- এমন সময় একজন পর্দাশীল বৃদ্ধ বয়সী নারী নবীজীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাইলে নবীজী সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। সেই বৃদ্ধাকে দেখামাত্র নবীজি তৎক্ষণাত উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তাঁর গায়ের চাদর বিছিয়ে তাকে বসার জন্য অনুরোধ জানালেন। নবীজির এমন ব্যবহারে সাহাবীগন আশ্চর্য হলেন- বৃদ্ধার প্রস্থানের পর তার সম্পর্কে জানতে চাইলে নবীজি (স.) দুধ-মা হালিমার পরিচয় শ্রদ্ধার সাথে তুলে ধরলেন। মা-হারা নবী (স.) তাঁর দুধ মা হালিমাকে এতটাই শ্রদ্ধা করতেন যে, মা হালিমাকে দেখলে তিনি পৃথিবীর সবকিছু ভুলে শুধু তার বক্তব্যেরই অপেক্ষা করতেন। পৃথিবীর সব মা’কেই আমার শ্রদ্ধাভরা সালাম।
পৃথিবীর প্রায় সব মা’ই তার সন্তানকে পরম আদরে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে চান। এদের মধ্যে আবার কিছু মা আছেন যাদের সন্তান শত দু:খ-কষ্টকে জয় করে পৃথিবীতে যোগ্য নাগরিক হিসেবে দেশ, জাতি তথা সমগ্র পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করে তোলে। এমন সন্তানের মায়েদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এই মায়েদের আমরা ‘রতœগর্ভা মা’ হিসেবেই চিনে থাকি এবং শ্রদ্ধা করি। এমন একজন রতœগর্ভা মা-ই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছেন। পৃথিবীবাসীর পক্ষ থেকে এই মায়ের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা ও শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা।
বাগেরহাটের করিম পরিবারের মমতাময়ী মা মরহুমা হামিদা বেগম (৯৩) গত ৫ ফেব্রুয়ারী’২০১৭ নিউইয়র্কে ইন্তেকাল করেন (ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্নাল্লিাহি রাজেউন)। ৭ ছেলে ও ৪ মেয়ে, নাতি-নাতনী, নিকটাত্মীয় সহ বহু গুনগ্রাহীদের কাঁদিয়ে তিনি পরকালের উদ্দেশে যাত্রা করেন। মরহুমার স্বামী মৌলভী শেখ আব্দুল করিম স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও একজন সম্মানিত স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ১১ জন সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে ইন্তেকাল করেন। ১১ সন্তানের বিশাল এই দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বহু প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিয়ে প্রত্যেক সন্তানকে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করেন এই মহিয়সী নারী। তার সন্তানরা আজ কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বা ডাক্তার, কেউ ব্যাংকার, কেউ আমেরিকার মতো দেশে ফেডারেল জব করছেন। এক কথায় সকলেই সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রায় ৭০ জন সদস্যের এক বিশাল পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। আসলে এমন মায়ের কখনই মৃত্যু হয় না। তাঁর কর্মফল তাকে পৃথিবীতে শতাব্দির পর শতাব্দি বাঁচিয়ে রাখবে।
মরহুমার নামাজে জানাজা জ্যামাইকার মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় বিপুল সংখ্যক আত্মীয়-স্বজন সহ প্রবাসীরা অংশগ্রহন করে। মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় কুইন্সের জ্যামাইকার ঘরোয়া রেস্টুরেন্টে এক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। উক্ত দোয়া মাহফিলে কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত নিকটাত্মীয় সহ বহু গুণগ্রাহী উপস্থিত ছিলেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারী’২০১৭ মরহুমা হামিদা বেগমের মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানো হয়। সেখানে বাগেরহাটের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।