টাঙ্গাইল: ‘এমপি রানার নির্দেশেই আমাকে হত্যা করতে হামলা চালানো হয়। মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলায় এমপিসহ জড়িতদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকায় এ হামলার পরিকল্পনা করা হয়। আল্লাহর রহমতে কোনোমতে জীবনে বেঁচে গেলেও ওরা আমাকে চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমি এ হামলার সুষ্ঠু বিচার চাই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলের ছাত্রলীগ নেতা আবু সাঈদ ওরফে রুবেল। এদিকে ঘটনার বিচারের দাবিতে সরকারি দলের একাংশ ছাড়াও সাধারণ মানুষ সোচ্চার। তারা এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর বর্তমানে কারাগারে আছেন। কারাগারে থাকাবস্থায় তিনি ছাত্রলীগ নেতা রুবেলের ওপর হামলা চালাতে নির্দেশ দেন বলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে গ্রেফতার হওয়া আসামি জুব্বার। গত ডিসেম্বর মাসে আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর পুলিশ বিষয়টি গোপনীয় প্রতিবেদন আকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। হামলার শিকার আবু সাঈদ ওরফে রুবেল ঘাটাইল সরকারি জিবিজি কলেজের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক এবং বর্তমানে ছাত্রলীগ সমর্থিত প্যানেলের ভিপি।
গত ১৩ জানুয়ারী শুক্রবার দুপুরে ঘাটাইল পৌর এলাকার চান্দুশী এলাকায় (সরকারি কলেজের পাশে) রুবেলের বাড়িতে যান যুগান্তর-এর ঘাটাইল তিনিধি। এ সময় তার ওপর হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এমপি রানার নির্দেশেই তার ক্যাডার বাহিনী আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই হামলা করে। মাস্টার প্ল্যান করে তারা পরিকল্পিতভাবে আমার ওপর কয়েক দফা হামলা চালায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি জীবনে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছি।’ তিনি জানান, ‘হামলাকারীদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছে। অন্যদের মধ্যে দু’জন ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা মামলা তুলে নিতে মোবাইল ফোন ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে হুমকি দিচ্ছে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যারা হামলা করেছে তারা সবাই এমপির ক্যাডার বাহিনী ও ঘনিষ্ঠজন।’ কেন তার ওপর হামলা করা হল জানতে চাইলে আবু সাঈদ বলেন, ‘সবাই জানে আওয়ামী লীগ নেতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলায় এমপি রানাসহ তার ভাইয়েরা জড়িত। আমি প্রথম থেকেই এ হত্যায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে সোচ্চার ছিলাম। মূলত এ কারণে আমাকে হত্যা করতেই এমন পথ বেছে নেয়া হয়েছে। কারাগারে আটক থাকলেও সেখান থেকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন আমাকে মেরে ফেলতে।’ তিনি বলেন, ‘আমার ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। কিন্তু হামলার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারীসহ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী আমার আর্জি শুনবেন।’ এছাড়া তিনি নিরাপত্তাহীনতার আশংকা প্রকাশ করে এ বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতা আবু সাঈদের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা চালায় ৯ নভেম্বর। ওইদিন রাতে তিনি ওয়াজ মাহফিল শুনে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় এমপির ক্যাডাররা তার ওপর অতর্কিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তাকে ফেলে রেখে যায়। এরপর প্রথমে তাকে টাঙ্গাইল সদরে, পরে আশংকাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সন্ত্রাসীরা তার শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে ৩৮টি আঘাত করে। এতে তার হাতের দুটি আঙ্গুলও সম্পূর্ণ কেটে যায়। সাঈদ এখন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। তাকে ক্রাসে ভর দিয়ে চলতে হয়।
এদিকে ঘটনার পর ১০ নভেম্বর ১৭ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ মামলার অন্যতম আসামী আব্দুল জুব্বার, ছাত্রলীগের নেতা আতিকুর রহমান ও যুবলীগের নেতা আজিজুল হক রুনুকে গ্রেফতার করে। এরপর পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়ার পর আব্দুল জুব্বারকে ২০ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করা হয়। টাঙ্গাইলের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শেখ সামিদুল ইসলামের কাছে সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। আর এই জবানবন্দিতে এমপি রানার নির্দেশেই তারা হত্যার উদ্দেশে ছাত্রলীগ নেতা আবু সাঈদ রুবেলের ওপর হামলা করে বলে স্বীকার করেন। আর এ হামলার পরিকল্পনা করা হয় কারাগারে থাকা এমপি রানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
এছাড়া জবানবন্দিতে জুব্বার আরও জানায়, ‘এমপি রানার সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে দেখা করতে গেলে তিনি ছাত্রলীগ নেতা রুবেলকে কিছু করতে না পারার কারণে তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে আরেক দিন দেখা করতে গেলে তার সহযোগী খোরশেদ আলমকে দিয়ে ‘কাজটা’ (হামলা ও হত্যা) করতে নির্দেশ দেন। এরপর এমপি রানার ঘাটাইলের বাড়িতে চার দিন ধরে হত্যার জন্য হামলার পরিকল্পনা করা হয়। ওই বৈঠকে জুব্বার ছাড়াও আজিজুল হক, খোরশেদ, পিচ্চি সেলিম উপস্থিত ছিলেন। হামলার আগের রাতে এমপির বাসায় খোরশেদ, আতিক, পিচ্চি সেলিম, আজিজুল ও খোরশেদের দুই সহযোগী বৈঠক করে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী খোরশেদ গরু কাটার পাঁচটি ছুরি নিয়ে মোটরসাইকেলে করে তার একজন সহযোগীসহ আগেই ঘটনাস্থলে চলে যায়। অন্যরা রিকশায় ও হেঁটে যায়। জুব্বার জানায়, ‘আমি ও পিচ্চি সেলিম পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ওয়াজের মাঠে পৌঁছাই। আমাদের দায়িত্ব ছিল রুবেল বের হলে তাদের জানানো।’
সাঈদের বড় ভাই ওসমান গনি বলেন, ‘যারা আমার ভাইকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করেছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।’
ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম লেবু জানান, ছাত্রলীগ নেতা রুবেল এলাকায় এমপি রানার সব অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং ফারুক হত্যা মামলায় এমপি ও তার ভাইদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতেন বলেই তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
আওয়ামী লীগ নেতা নিহত মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ বলেন, এমপি রানা ও তার ভাইয়েরা আওয়ামী লীগ নেতা ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদের মতো নেতাকে যারা হত্যা করতে পারে, তাদের কাছে এ ধরনের হামলা করা খুবই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, মূলত তার স্বামী হত্যার বিচার চাওয়ায় আবু সাঈদকেও হত্যা করতে এমপির ক্যাডাররা জঘন্যতম এ হামলা চালিয়েছে। তিনি জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
ছাত্রলীগ নেতা আবু সাঈদকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম প্রধান রুপকার এমপি রানার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, এ চক্র আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার মামলারও আসামি। তাই এদের সবার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. মাহবুব আলম পিপিএম বলেন, আবু সাইদ রুবেলকে হত্যা চেষ্টা মামলার একজন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তার স্বীকারোক্তিসহ মামলার পুরো বিষয় তদন্ত করে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেয়া হবে।
এমপি রানা গ্রুপের নেতা ঘাটাইল উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান সামু দাবি করেন, টেম্পো স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারার বিরোধ নিয়ে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে রুবেল আহত হয়। এখানে কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই। অথচ এখন এমপি রানাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা ২২ মাস পলাতক থাকার পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। একই মামলার আসামি তার তিন ভাই- টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা গা ঢাকা দিয়ে আছেন। (দৈনিক যুগান্তর)