সৈয়দ আবুল মকসুদ: যে ভূখন্ড নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত, সেখানকার মানুষ গত ১১০ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ পায়। ভাগ্য বদলাতে অগণিত মানুষ অকাতরে আত্মাহুতি দেয়। অপরিমেয় রক্ত, দুঃখ-কষ্ট ও অপমানের বিনিময়ে জাতির জীবনে আসে সুযোগ। কিন্তু কোনো সুযোগই বাংলার মানুষ ষোলো আনা কাজে লাগাতে পারেনি। কোনো কোনো আন্দোলন আংশিক সফল হয়েছে। কোনো কোনোটি একেবারেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। যেমন আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অর্জন।
সাধারণ মানুষ বছরের বিশেষ বিশেষ দিনকে স্মরণ করে। কিন্তু সুখের স্মৃতি নয়, সেই দিনকে স্মরণ করতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হয় দুঃখ ও হতাশায়। তারা যা চেয়েছে তা পায়নি। যা কল্পনা করেনি, যা চায়নি, পেয়েছে তা-ই। তেমন একটি দিন ৬ ডিসেম্বর। আজ সেই ৬ ডিসেম্বর।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার প্রবর্তিত হয়। তাতে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।’ পরবর্তীকালে সামরিক শাসকেরা নানা রকম গোঁজামিল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও সংসদীয় গণতন্ত্রে আর ফিরে যাননি। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯৮১ সালে নিহত হওয়ার পর উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তারপর সংবিধান অনুযায়ী ১৯৮১-র ১৫ নভেম্বর প্রত্যক্ষ ভোটে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রার্থী। ৩১ জন প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন কামাল হোসেন। বিচারপতি সাত্তার পেয়েছিলেন ১ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫৮ ভোট, কামাল হোসেন পেয়েছিলেন ৫৬ লাখ ৩৬ হাজার ১১৩ ভোট। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছিল বলেই সব পক্ষ অভিমত দেয়। সাত্তারের সরকার ছিল সম্পূর্ণ সংবিধানসম্মত এবং গণতান্ত্রিক সরকার। তাঁর সরকারেও যথাপূর্ব দুর্নীতি ছিলপ্র্রচুর, কিন্তু সাত্তারের প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি। কারণ, ফজলুল হকের সময় থেকে দেশের সব সরকারের সঙ্গেই দায়িত্বপূর্ণ কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন তিনি এক হাতে পরিচালনা করেন অসামান্য নিরপেক্ষতার সঙ্গে, যে নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। যার ফলে বদলে যায় দেশের ইতিহাস। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগান। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা করপোরেশন পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেন, সাংবাদিকদের প্রথম বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান করেন এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ নিতেন। তাঁর অল্পকাল শাসনকালে রাষ্ট্রপতি সাত্তার ব্যাংক কর্মচারী নেতাদের অন্যায্য দাবিদাওয়া ও আবদারকে কঠোরভাবে দমন করেন।
জিয়াউর রহমানের পরে, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি সাত্তারের নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সরকারে সেনাবাহিনীর প্রভাব কমে আসে। নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও একটি নির্বাচিত বেসামরিক সরকার যখন কাজ শুরু করছিল, তখন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ওই সরকারকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে থাকেন। সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার অংশীদার করতে হবে এমন দাবিও তোলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি সরকারের ব্যর্থতার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য দিতে থাকেন। এ দেশের একশ্রেণির মধ্যবিত্তের যে গণতন্ত্র ভালো লাগে না, তা আমরা এখনকার মতোই সব সময় লক্ষ করেছি। চিরকালই সরকারি দলেও থাকে কিছু মীর জাফর।
সাত্তারের নির্বাচিত সরকার যদি খুব খারাপ হতো, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোই রাস্তায় নামত এবং আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা হতে পারত। কিন্তু তা হলো না। সাড়ে চার মাসের মধ্যে বন্দুকের নলের মুখে বিনা রক্তপাতে তাঁকে সরানো হলো। ব্যক্তিকে নয়, তাঁর সরকারকেই। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসের মাত্র দুই দিন আগে খুব সকালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন জেনারেল এরশাদ। তিনি তাঁর ঘোষণায় বলেন, ‘যেহেতু দেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যাতে অর্থনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে অচলাবস্থা, বেসামরিক প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছে না, সকল স্তরে যথেষ্ট দুর্নীতি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে……বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এবং জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে কষ্টার্জিত দেশকে সামরিক আইনের অধীনে ন্যস্ত করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে…।’ প্রায় ৮০-র কাছাকাছি বয়সে ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি বন্দুকের গুলিতে মরতে চাননি বলে তিনিও বেতার-টেলিভিশনে ‘বাংলাদেশে শান্তি, ন্যায়বিচার, প্রগতি ও সমৃদ্ধির এক নবযুগের সূচনা’ হবে বলে নতুন সরকারের ‘সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা’ করেন। ওই কামনা যে তিনি অন্তরের অন্তস্থল থেকে করেছিলেন, তা পরে তিনি দেশের মানুষকে জানিয়ে দিয়ে মারা গেছেন।
২৭ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেইন রাষ্ট্রপতির শপথবাক্য পাঠ করান। সামরিক ঘোষণাবলে তাঁকে নবম রাষ্ট্রপতি ‘মনোনীত’ করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ আমলের রাষ্ট্রপতি এবং মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ১৬ জুলাই জেনারেল এরশাদ ‘শিক্ষার উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের চরিত্র’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের ঘোষণা দেন। কিন্তু দেশের ছাত্র-যুবসমাজ মনে করে, তাদের অতি বেশি ভালো চরিত্রের প্রয়োজন নেই, যে চরিত্র হাজার বছর যাবৎ আছে, সেটাই থাক।
সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম চলছিল ব্যাপকভাবে। শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগের নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ১৯৮৩-র জানুয়ারিতে ৪৪ জন কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক ‘ঐক্যবদ্ধভাবে একুশে ফেব্রুয়ারী পালনের’ আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, তার ‘মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐতিহ্য ও মূল্যবোধগুলিকে রক্ষার চেতনা পুনরায় শাণিত করে তোলা’ হোক।
নির্দলীয়ভাবে দ্রুত গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২৬ মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বরে আয়োজিত এক সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫টি দল একটি ৫ দফা ঘোষণা দেয়। কয়েক মাস পরে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হয় ৭-দলীয় একটি জোট। তারাও ওই ৫ দফার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। শুরু হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোট এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোটের ‘অভিন্ন দাবি আদায়ের’ সংগ্রাম। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সেই আন্দোলনে ক্ষতি হয় যা, তা হলো জামায়াতে ইসলামীও সেই আন্দোলনের সঙ্গে জুটে যায়। আন্দোলনের স্বার্থে দুই জোটই জামায়াতের সঙ্গে প্রণয় করতে থাকে।
কী ছিল সেই ৫ দফায়? অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ছিল ‘অবিলম্বে দেশে জনগণের সকল মৌলিক অধিকারসহ গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে’ এবং ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে দেশে অন্য যেকোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই কেবলমাত্র সার্বভৌম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে’।
দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দুর্বার আন্দোলন হয়। তাঁদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথ উত্তাল করে রাখে তাদের ১০ দফা নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ১৭ দফা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, ৬ দফা দাবিনামা নিয়ে আইনজীবী সমিতিসমূহের সমন্বয় পরিষদ শামসুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে, বিস্তারিত ৫ দফা নিয়ে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এবং নাগরিকদের ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’।
সাড়ে আট বছরের সেই আন্দোলন নিয়ে আমার একটি বই বেরিয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। খবরের কাগজে নিহত ব্যক্তিদের নাম দেখে হিসাব করে দেখেছিলাম, সেই আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সাড়ে সাত শর মতো মানুষ জীবন দিয়েছিলেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন হাজার হাজার। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের শত শত নেতা কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তাঁদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াও আছেন। উত্তাল আন্দোলনের মধ্যে ৪ ডিসেম্বর রাতে রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ৬ ডিসেম্বর উপ রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন
এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। তাঁর অধীনে নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়, তবে সরকার গঠনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিএনপি জামায়াতকে দুটো মহিলা আসন উপহার দিয়ে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশে জামায়াত সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ পেয়ে সুযোগ হারালেন খালেদা জিয়া। আশির দশকের আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল আপসহীন, কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তিনি মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস করলেন। বাংলাদেশের যেকোনো ভালো শাসককে বাঙালি জাতির ইতিহাস জানতে হবে। সে ইতিহাসের শুরু একাত্তরে নয়, হাজার বছরেরও আগে। শুধু ইতিহাসও নয়, ভালো শাসককে বুঝতে হবে বাঙালি সংস্কৃতিকেও। বাঙালীর ইতিহাস ও সংস্কৃতি কোনোটিরই তিনি গুরুত্ব দিলেন না। তিনি ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চাইলেন। আওয়ামী লীগ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের সংগত দাবি করল। তিনি অগ্রাহ্য করে একতরফা নির্বাচন করলেন। ১৫ ও ৭-দলীয় জোটের অঙ্গীকার ভঙ্গ করলেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তিনিই প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা করেন।
বেগম জিয়ার পর শেখ হাসিনা ক্ষমতা পেয়ে তিনিও একই পথ অনুসরণ করেন। আবার ২০০১-এ ক্ষমতা গ্রহণ করে খালেদা জিয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অমর্যাদা করেন এবং যেকোনো রকমে পুননির্বাচিত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাঁর ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিক মদদে অগণতান্ত্রিক উদ্দিনীয় সরকার আসে। ২০০৯-এর নির্বাচিত শেখ হাসিনার সরকার অনেক দিন হয়ে যাওয়ায় আশির দশকের অঙ্গীকারের কথা বেমালুম ভুলে যায়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের পুনর্জন্মের ব্যবস্থা থাকলে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের পরে বাংলার মাটিতে এসে সেøাগান দিতেন: গণতন্ত্র যদি নিপাত যায় তো যাক!
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক। (প্রথম আলো)