ঢাকা: প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আইনগতভাবে মুক্ত গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বাস্তবে তার উপস্থিতি কম। কখনো রাজনৈতিকভাবে, কখনো ব্যবসায়িক আবার কখনো ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার অজুহাতে গণমাধ্যমের স্বাধীন মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নের নাম দিয়ে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারে সাংবাদিকতার ধারা পাল্টে গেছে। এ দুটি মাধ্যম অনেকটা মতামতধর্মী। সেই ধারাটিই এখন প্রকৃত সাংবাদিকতার ওপর চেপে বসেছে, যার কারণে হারাতে বসেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষকে নিজেদের মতামত প্রচারের ক্ষমতা দিলেও প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকতা নগরকেন্দ্রিকতা থেকে বের হতে পারেনি। যে কারণে বিপুলসংখ্যক প্রন্তিক জনগোষ্ঠীর মতামত গণমাধ্যমে যথাযথভাবে উঠে আসছে না।
প্রথম আলোর ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের অংশ হিসেবে আয়োজিত আলোচনায় যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, ভারত, নেপাল, ভুটান, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, সেøাভাকিয়াসহ বিশ্বের নয়টি দেশ থেকে আসা ২০ জন সংবাদপত্রের সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করেন এমন বিশিষ্টজনেরা এই অভিমত তুলে ধরেন। শুক্রবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে গণমাধ্যম নিয়ে এক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন তাঁরা। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের সঞ্চালনায় এ আলোচনায় স্বাগত ও সমাপনী বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানসহ প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ সংবাদকর্মীরা।
ভারতের অন্যতম বড় দৈনিক ভাস্কর-এর গ্রুপ এডিটর ও এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়ার সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দুবে বলেন, প্রতিটি দেশের সংবিধানে, আইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা যখনই বাস্তবায়নের সময় আসে, তখনই ক্ষমতাসীনেরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সবকিছুকে এড়িয়ে তারা (ভারত সরকার) তথ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির সুপারিশে এক দিনের জন্য এনডিটিভি ইন্ডিয়া বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিল।
বিশ্বের সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ান-ইফরার দক্ষিণ এশিয়া শাখার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাগদুম মোহামেদ সরাসরিই বললেন, আইনে গণমাধ্যমের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু বাস্তবে নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সবার নজর দেওয়া উচিত।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপছন্দের সংবাদ প্রকাশ করায় গণমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার উল্লেখ করে অস্ট্রিয়াভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) নির্বাহী বোর্ডের চেয়ারম্যান জন ইয়ারউড বলেন, তিনি তুরস্কে ও জাম্বিয়ায় বিরোধী মতের পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা দেখেছেন। তিনি মনে করেন, যেকোনো সমাজের জন্যই মুক্ত গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জরুরি।
গণমাধ্যম বন্ধের পাশাপাশি সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনাও উদ্বেগ ছড়াচ্ছে উল্লেখ করে এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সাপোর্টের (আইএমএস) কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এসবেন কিউ হারবো বলেন, সারা বিশ্বের গণমাধ্যম আজ সংকটে। গত ১৮ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার খানেক সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের মধ্যে এখন ঐক্য খুবই দরকার।
নেপালের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক কান্তিপুর-এর প্রধান সম্পাদক সুধীর শর্মা বলেন, নেপালের সংবিধানে গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা আছে। তা সত্ত্বেও স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বড় বড় ব্যবসায়ী মিডিয়াতে বিনিয়োগ করছেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য যতটা না সৎ সাংবাদিকতা, তার চেয়ে বেশি অন্য স্বার্থ।
ভারতের দৈনিক দ্য হিন্দুর সম্পাদক মুকুন্দ পদ্মনাভন বলেন, ভারতেও পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মামলা দিয়ে হয়রানির ধরনটা বাংলাদেশের মতো। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময়ের অপচয় হচ্ছে। তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, তাঁদের স্থানীয় প্রশাসনের হুমকির মুখে থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে তা তৃণমূল পর্যায় থেকেই করা জরুরি।
ত্রিপুরার দৈনিক দেশের কথার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গৌতম দাস বলেন, ভারতে স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর পত্রিকার ওপর ৫০০ বারেরও বেশি আক্রমণ হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে চাপ তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে মামলা তো রয়েছেই।
ভারতের মেঘালয়ের দ্য শিলং টাইমস-এর সম্পাদক প্যাট্রিসিয়া মুখিম বলেন, ভারতে আইনগতভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সবাই নিজেদের মনের কথা খুলে বলতে পারে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতায় দরকার, যেখানে আমার মনের কথা আমি মন খুলে বলতে পারব।
শহুরে সাংবাদিকতা, মার্কিন নির্বাচনের ভূল পূর্বাভাশ
সাংবাদিকতা এখনো শহরের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ উল্লেখ করে ভারতের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক স্বাতী ভট্টাচার্য বলেন, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ যতক্ষণ না কলকাতা শহরে হানা দিয়েছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যমগুলো নীরব ছিল। আমাদের এখনো এ অবস্থা রয়ে গেছে। মফস্বলের সাংবাদিকতা অনেকটাই জেলা প্রশাসক আর জেলার পুলিশ প্রধানের কার্যালয়নির্ভর। এর বাইরে গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা গণমাধ্যমে খুব কমই উঠে আসছে। তিনি বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মতামতকে উপেক্ষা করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচন সম্পর্কে ভুল পূর্বাভাস দিয়েছিল, যে কারণে সব গণমাধ্যম হিলারির জয়ের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পই জয়ী হয়েছেন।
প্রায় ১০০টি দেশের সাংবাদিক, সম্পাদক ও গণমাধ্যম-নির্বাহীদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বারবারা ত্রিয়োনফি বলেন, ‘আমাদের দেশের (সাধারণভাবে ইউরোপে) মানুষ গণমাধ্যমে আস্থা রাখে না। কোনো সমস্যায় পড়লে তারা সাংবাদিকদের কাছে যায় না। তারা যায় রাজনীতিবিদদের কাছে।’
আবার ভুটানে গণমাধ্যমের প্রভাব বাড়ছে উল্লেখ করে জাতীয় দৈনিক কুয়েনসেল পত্রিকার প্রকাশনা বিভাগের সম্পাদক উখিয়্যান পেনজর বলেন, আগে কোনো সমস্যা হলেই মানুষ রাজার কাছে যেত। কিন্তু এখন তারা সাংবাদিকদের কাছে যাচ্ছে। ওই পত্রিকার সম্পাদক রিনঝিন ওয়াংচুক বলেন, মানুষ গণমাধ্যমের কাছে আসে। কিন্তু ছোট দেশ ভুটানে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সেøাভাকিয়ার দৈনিক এসএমইতে কর্মরত সাংবাদিক মাতুস কেরাসিমারিক বলেন, মানবাধিকার প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমগুলোকে দায়িত্ববান হতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব
সাংবাদিকতার ওপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভারতের দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর প্রধান সম্পাদক রাজ কমল ঝা বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের কারণে সবাই নিজেকে ভাবছে সাংবাদিক। সবার হাতে হাতে ছবি তোলার মতো মোবাইল, যে কেউ যেকোনো কিছু লিখতে পারছে, যা খুব সহজেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকদের তথ্য যাচাইয়ের বিষয়গুলো দেখতে হবে। আজকের এ যুগে সবার মত আছে। সবাই সে মতটা চাপিয়ে দিতে চায়। তিনি বলেন, টিভিতে কেউ কেউ এসে কথা বলে অনেক বড় তারকা বনে যাচ্ছেন। তাঁরা এসে সরকারের পক্ষে কথা বলছেন, তাঁরা এমনও বলছেন যে সাংবাদিকদের (পেশাদার) গ্রেপ্তার করতে হবে। আজউন্নয়ন ও জাতীয়তাবাদকে স্বাধীন সাংবাদিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজ কমলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) দক্ষিণ এশিয়া সংবাদ পরিচালক বার্নাত আর্মেঙ বলেন, আমাদের পাঠকদের মাধ্যম পরিবর্তন হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা আমাদের খবরগুলো দেখছে, পড়ছে। যে চ্যালেঞ্জগুলো এখন তৈরি হচ্ছে, সেগুলো মোকাবিলার জন্য ঐক্য প্রয়োজন।
ফিনল্যান্ডের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হেলসিঙ্গিন সানোমাট-এর কূটনৈতিক সম্পাদক কারি হুতা বলেন, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলা, ব্রেক্সিট, ট্রাম্পের বিজয়— সব কিছু মিলিয়ে গত কয়েক দিনেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট অনেকখানি পাল্টে গেছে। সাংবাদিকতার দিক থেকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
নেপালের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক কান্তিপুর-এর প্রধান সম্পাদক সুধীর শর্মাও ছাপা পত্রিকা ও সাংবাদিকতার জন্য তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবিকাশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন।
নারী সাংবাদিকদের মূল ধারায় নিয়ে আসা
স্বাতী ভট্টাচার্য বলেন, গণমাধ্যমে মূলধারার কাজে, অর্থাৎ রিপোর্টিংয়ে মেয়েদের উপস্থিতি একেবারেই নেই। পশ্চিমবঙ্গের কোনো জেলায় তিনি একজনও নারী রিপোর্টার দেখেননি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এটা তাহলে কেমন গণতন্ত্র, যেখানে মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই? প্যাট্রিসিয়া মুখিমও সাংবাদিকতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর তাগিদ দেন। আসামের সাময়িক প্রসঙ্গ-এর সম্পাদক তৈমুর রেজা চৌধুরী একই অভিমত দেন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়ার প্রেসিডেন্ট জ্যোতি মালহোত্রা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংবাদ বিনিময়ের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ছাপা কাগজের সংবাদ বিনিময় সম্ভব না হলে প্রযুক্তির সহায়তায় ডিজিটাল কনটেন্ট শেয়ার করতে পারে তারা।
সঞ্চালকের বক্তব্য: আলোচনার সঞ্চালক ও ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, পৃথিবীজুড়ে সংবাদপত্রের ভাষা হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সাংবাদিকতার আবেগ ও ধরন একই। সমস্যাগুলোও প্রায় একই। তাই এখন সময় এসেছে সংহতির। পারস্পরিক যোগাযোগকে আরও বেশি সুদৃঢ় করার।
আলোচনার শেষ ভাগে এক ভিডিওবার্তায় শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) নির্বাহী পরিচালক জোয়েল সায়মন। অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথিদের সামনে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ও তথ্যচিত্রের মাধ্যমে প্রথম আলোর বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। (প্রথম আলো)