ঢাকা: পরিবর্তনের বার্তা দিয়ে ২২ অক্টোবর শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল। রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দু’দিনব্যাপী এ সম্মেলন শেষ হবে ২৩ অক্টোবর রোববার। আওয়ামী লীগের পরবর্তী তিন বছরের নেতৃত্বের চাবিও তুলে দেয়া হবে ওইদিন। শুক্রবার থেকে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় কে কোন পদ পাচ্ছেন। হঠাৎ করেই নতুন গুঞ্জন উঠেছে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে। এ নিয়ে আগাম অভিনন্দনও জানানো শুরু হয়েছে। এদিকে শনিবার সকালে সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনের শ্লোগান ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার’।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনের এক সমাবেশ থেকে আত্মপ্রকাশ করে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ (প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ থাকলেও পরে নামকরণ হয় আওয়ামী লীগ)। সে হিসেবে সময়ের পরিক্রমায় ৬৭টি বছর পার করেছে উপমহাদেশেরও অন্যতম পুরনো এ রাজনৈতিক দলটি। আওয়ামী লীগের এটি ২০তম সম্মেলন। এর আগে ১৯৫৩ সালে ময়মনসিংহে প্রথম সম্মেলনের পর বিভিন্ন সময়ে আরো ১৯টি জাতীয় সম্মেলন করেছে দলটি। এর মধ্যে ময়মনসিংহে প্রথম সম্মেলন এবং ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সম্মেলন ছাড়া বাকি সব সম্মেলন হয়েছে ঢাকায়। ২০০০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ কাউন্সিল। ২০১২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে সর্বশেষ সম্মেলন। দলের ২০তম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি শেষ করেছেন বলে জানান দলটির কেন্দ্রীয় ও মহানগর পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এরই মধ্যে সারাদেশ থেকে রাজধানীতে এসে পৌঁছেছেন ১৩ হাজারের বেশি কাউন্সিলর ও ডেলিগেট। পাশাপাশি দলের কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী দুদিনের কাউন্সিলে সরব হবেন। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের আশা, সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব পাওয়ার পাশাপাশি আরো চাঙ্গা হবে আওয়ামী লীগ।
নেতৃত্ব নির্বাচন: সম্মেলনের প্রথম দিন হবে উদ্বোধনী অধিবেশন। এদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকাল ১০টায় বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে দলের ২০তম সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ, শোকপ্রস্তাব, আগত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে অভ্যর্থনা উপ কমিটির আহ্বায়কের বক্তব্য, সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন পেশ, অতিথিদের বক্তব্য এবং সর্বশেষ সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের কর্মসূচি শেষ হওয়ার কথা। এদিন কাউন্সিলর, অতিথি এবং নেতা-কর্মীরা উপস্থিত থাকবেন। উদ্বোধনী অধিবেশন এবং প্রথম দিন সন্ধ্যায় থাকছে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এরই মধ্যে থিম সং গাওয়ানো হয়েছে জনপ্রিয় গায়ক বাপ্পা মজুমদারকে দিয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি তা পরিবেশন করবেন। এছাড়া থাকবে জাতীয় সংগীত, দেশাত্মবোধক গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিজ নিজ সংস্কৃতির গান ও নাচ। এরপরে রোববার সকাল ১০টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বসবে দলটির কাউন্সিল অধিবেশন। এখানেই ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের সংযোজন-বিয়োজন হবে। দলের তৃণমূলের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলবেন জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা। এই অধিবেশনেই নির্বাচিত হওয়ার কথা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তবে অধিবেশনটি হবে রুদ্ধদ্বার। সেখানে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার থাকবে না। এদিকে সম্মেলনের বিভিন্ন প্রকাশনা দেয়া হবে নেতা-কর্মীদের। সভাপতির ভাষণ, সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট, শোক প্রস্তাব। প্রচারণার জন্য বানানো হয়েছে একাধিক সিডি। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য, আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতিটি খাতে তুলনামূলক পদক্ষেপের চিত্র, বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কাউন্সিলর-অতিথিদের দেয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে ব্যাগ ও টুপি।
রাজধানীজুড়ে সাজ সাজ রব: এদিকে আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে গোটা রাজধানীতে এখন সাজ সাজ রব। দলটির কেন্দ্রীয় ও শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, সম্মেলনে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে অংশ নেবেন সারা দেশ থেকে আসা ১৩ হাজারের বেশি কাউন্সিলর ও ডেলিগেট। সম্মেলন ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও এর আশপাশের সড়কসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো সাজানো হয়েছে রঙিন সাজে। সন্ধ্যা নামতেই সম্মেলনস্থলসহ সড়কগুলোতে চলছে আলোর রোশনাই। এ যেন নতুন এক নগরী। শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখা গেছে, কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে মঞ্চ, প্যান্ডেল, গেট, তোরণ নির্মাণসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। মৎস্যভবন অভিমুখী ও শাহবাগ শিশুপার্ক সংলগ্ন মূল প্রবেশদ্বারসহ উদ্যানের প্রত্যেকটি প্রবেশমুখ সাজানো হয়েছে মনোরম সাজে। উদ্যানসহ আশপাশের সড়কগুলোতে থাকছে আলোকসজ্জা। পুরো উদ্যানজুড়ে থাকছে দেশের মুক্তিসংগ্রাম, আওয়ামী লীগের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমন্ডিত নানা উপস্থাপনা। এছাড়াও থাকছে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, সামছুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার স্থিরচিত্র। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত ও বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচিরও প্রচার থাকছে উদ্যান ও রাজধানীজুড়ে। উদ্যানের পূর্ব দক্ষিণ কোণে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে তৈরি হয়েছে বিশাল মঞ্চ। ১৫০ ফুট লম্বা ও ৪৮ ফুট প্রশস্ত এই সুসজ্জিত মঞ্চ দৃষ্টি কেড়েছে সকলের। মঞ্চের সামনেই তৈরি করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। ২৫ হাজার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই প্যান্ডেলে নেতাকর্মী ও আমন্ত্রিত অতিথি বসতে পারবেন। পাশাপাশি সম্মেলনস্থলের অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজও ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আশা, ব্যাপক জাঁকজমকপূর্ণ এবারের সম্মেলন ইতিহাস হয়ে থাকবে। ব্যাপক জনসমাগম অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাবে। অন্যদিকে দলের কেন্দ্রীয়, মহানগরসহ তৃণমূলের নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা বলছেন, আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলন অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল, আকর্ষণীয় ও সৌন্দর্যমন্ডিত।
থাকছে ৫০ হাজার লোকের খাবারের ব্যবস্থা: আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে দলের নেতাকর্মী, বিদেশি ও অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথিসহ ৫০ হাজার লোকের খাবারের ব্যবস্থা থাকবে। সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত খাদ্য উপ-কমিটির নেতৃবৃন্দ জানান, খাবার নিয়ে কোনো ধরনের কার্পণ্য ও কমতি যেন না হয় সে বিষয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। নেতৃবৃন্দ জানান, ২২ অক্টোবর সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে দুপুর ও রাতে এবং সম্মেলনের সমাপনী দিনে দুপুর বেলাসহ ২ দিনে তিনবেলা খাবারের আয়োজন থাকবে। সম্মেলনে খাবারের জন্য ১৫টি বুথ থাকবে। প্রতিটি বুথে ২০ জন পুলিশ থাকবে। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরাও দায়িত্ব পালন করবেন। সম্মেলনের প্রথম দিনে আগত ৩৫ হাজার নেতা-কর্মী ও অতিথিদের জন্য দুপুর ১টায় খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। রাতে সাড়ে সাত হাজার এবং সম্মেলনের শেষ দিন রোববার আরো ৮ হাজার লোকের খাবারের আয়োজন থাকবে। শেষ দিনে শুধু কাউন্সিলরদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা থাকবে বলে জানান খাদ্য উপ-কমিটির আহ্বায়ক, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিনি জানান, সম্মেলনের প্রথম দিনে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের জন্য ৩ হাজার, যুবলীগের নেতা-কর্মীদের জন্য ৩ হাজার, একইভাবে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২ হাজার, যুব মহিলা লীগের ১ হাজার, শ্রমিক লীগের জন্য ৫শ’ এবং কৃষক লীগের ৩শ’ নেতাকর্মীর জন্য খাবারের ব্যবস্থা থাকবে।
সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংকটময় পথ মাড়িয়ে এগিয়ে চলা: দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে উপমহাদেশের অন্যতম পুরনো রাজনৈতিক দলও। প্রতিষ্ঠালগ্নেই মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতাদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠা হয় আওয়ামী লীগের। ওই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনের এক সমাবেশ থেকে আত্মপ্রকাশ করে ঐতিহ্যবাহী এ রাজনৈতিক দলটি। তবে, প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। যাত্রার শুরুতে সংগঠনের সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন শামসুল হক। তখনকার তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে এর নামকরণ হয় আওয়ামী লীগ। সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের ধারবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের আন্দোলন, উন্নয়ন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। জন্মলগ্ন থেকেই দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বোধ থেকেই রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর ছিলেন সেই মুক্তির সংগ্রামের সর্বাগ্রে। তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। সঙ্গত কারণেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের নাম। ভাষা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, মুসলিম লীগ বিরোধী ২১ দফা প্রণয়ন ও যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৫৪-এর নির্বাচনে বিজয় ও মুসলিম লীগের ভরাডুবিসহ তৎকালীন নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ৫০-এর দশকেই পূর্ববাংলার রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। ওই সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য, অব্যাহত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলায় ক্রমশ বাঙালী জাতির আস্থাভাজন হয়ে ওঠে দলটি।
আওয়ামী লীগের হাত ধরেই তখনকার সাম্প্রদায়িক ভাবধারা কাটিয়ে ধীরে ধীরে আত্মসম্বিৎ ফিরে পায় বাঙালী জাতি। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবোধের স্ফূরণ ঘটে। একই সঙ্গে বাঙালীর স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে আরো অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। ৬০-এর দশকে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন, ৬৬-তে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের ম্যাগনাকার্টাখ্যাত ৬ দফা হয়ে ওঠে বাঙালীর মুক্তির সনদ। ৬ দফাভিত্তিক ছাত্র সমাজের ১১ দফা, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও তা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু’র মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমে আসা মানুষের ঢলে সৃষ্টি হয় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। যা স্বাধীনতার পথকে করে আরো বেগবান। এরপর ’৭০-এর নির্বাচনে ৬ দফার পক্ষে গণরায় এবং আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ ও বিপুল বিজয় পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভারসাম্যই বদলে দেয়। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ কেবল পূর্ব বাংলা নয়, পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। পরে স্বাধীনতার পর মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দুরূহ কর্মযজ্ঞ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই হত্যা করা হয় তাকে। তবে, মাত্র সাড়ে তিন বছরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে উন্নয়ন অভিযাত্রায় শামিল করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ তার লালিত স্বপ্ন আজও পূরণের চেষ্টা করে চলেছে তারই প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ। সদ্য স্বাধীন দেশে নতুন এক সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে দেশে সৃষ্টি হয় সামরিক স্বৈরশাসনের ধারা। এরপর থেকে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হয় আওয়ামী লীগ। যার নেতৃত্বে ছিলেন দলটির আজকের কান্ডারি শেখ হাসিনা।
প্রায় ছয় বছর বিদেশে অবস্থান করা পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। অবশ্য তার আগেই দলের অন্য নেতারা তাকে দলের সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেন। এরপরই দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নিরন্তর সংগ্রাম। দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৯০-এর শেষ দিকে স্বৈরশাসনের পতনের পর ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। যার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে দলটি।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নানা চড়াই-উৎরাই ও সংকট সময় পার করেছে আওয়ামী লীগ। যার সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাতে। কতিপয় বিপথগামী সৈনিক ওই রাতে হত্যা করে স্বাধীনতার স্থপতি, ‘জাতির পিতা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা, দলের বর্তমান কান্ডারি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। এরপর আরেকটি আঘাত আসে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ওই দিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে সন্ত্রাসীরা। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। নিহত হন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। অভিযোগ রয়েছে, এর উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে আসছে, তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই এ গ্রেনেড হামলা ও নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটানো হয়, যা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ধারাবাহিকতা। বিগত সময়ের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও সংকটে পড়তে হয় দলটিকে। ওই সময়ের ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। একই সঙ্গে কারান্তরীণ হন দলের অসংখ্য নেতা-কর্মী। যদিও শেখ হাসিনা ও দলের অন্য নেতৃবৃন্দের দৃঢ়চেতা মনোভাবের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় তখনকার সেনা সমর্থিত সরকার।(দৈনিক মানবজমিন)