নিউইয়র্ক: শেষ পর্যন্ত ভেঙেই গেল নিউইয়র্কের বাংলাদেশী সাংবাদিকদের প্রতিষ্ঠান আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব। গত সংখ্যায় ‘আজকাল’-এ এমন সম্ভাবনার আভাস দিয়ে বলা হয়েছিল প্রেসক্লাবের ভাঙন অনিবার্য। এই খবর প্রকাশের তিন দিনের মধ্যেই ক্লাবের দ্বিধাবিভক্তি চূড়ান্ত রূপ নেয়। দুই বিবদমান গ্রুপের পক্ষ থেকে দুটি পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। একটি কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সভাপতি পদে সাপ্তাহিক প্রবাস সম্পাদক মোহাম্মদ সাঈদ ও সাধারণ সম্পাদক পদে সাপ্তাহিক আজকাল-এর নির্বাহী সম্পাদক শওকত ওসমান রচি। অপর কমিটিতে রয়েছেন সভাপতি পদে সাপ্তাহিক ঠিকানা সম্পাদক লাবলু আনসার ও সম্পাদক পদে ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি শহীদুল ইসলাম। দুটি কমিটি ঘোষণার পর পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কার নিয়ন্ত্রণে যাবে আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব? কারাই-বা ব্যবহার করবেন সংগঠনের লোগো? দুটি কমিটির মধ্যে বৈধ কমিটি কোনটি? এমন পরিস্থিতিতে প্রেসক্লাব ভাঙনের পর এবার সংঠনের নাম ও লোগো ব্যবহারের ক্ষমতাটি যে সহজে নির্ধারণ হচ্ছে না তা বলাই যায়। তবে কী আইনী প্রক্রিয়ার দিকে যেতে হবে দুই পক্ষকে? এ অলোচনা চলছে সাংবাদিক মহলে।
এ বিষয়ে আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক দর্পণ কবীর বলেন, ‘বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি সংগঠনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তাই এই কমিটির কার্যকরী সভায় যাদেরকে মনোনীত করা হয়েছে তারাই বৈধ কমিটি। অর্থাৎ সভাপতি মোহাম্মদ সাঈদ ও সাধারণ সম্পাদক শওকত ওসমান রচির নেতৃত্বে কমিটিই বর্তমান নাম ও সংগঠনের লোগো ব্যবহার করার এখতিয়ার রাখেন।’ বর্তমান কমিটিও নতুন এই কমিটির কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে বলে জানান দর্পণ কবীর। তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনারদের অব্যাহতি দিয়ে কমিশন বিলুপ্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদের তিনজনকে সংগঠন থেকে বহিস্কারও করা হয়েছে। তাই তাদের নির্বাচন করার আইনগত বৈধতা নেই। কোনো কমিটি নির্বাচনেরও এখতিয়ার নেই।’
দর্পণ কবীর জানান, ‘যাদের নামে কমিটি নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে তাদের অনেকেই সদস্য চাঁদা পর্যন্ত দেননি। যারা সদস্য চাঁদা দেননি তারা কিভাবে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হন।’ ‘পরগাছা’দের সংগঠনে কোনো গুরুত্ব নেই বলে মন্তব্য করেন বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
নতুন কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে আমার প্রশ্ন ‘এভাবে নির্বাচন না করে আরেকটু সময় নেয়া যেতো না? কার্যকরী কমিটির সভায় নতুন কমিটি গঠন হয়েছে। আমরা তো বলবো, আমরা সময় নিচ্ছি। আমরা সমাজের বাইরে নই। আমরা মানুষের সমালোচনা করি। আমাদের নিজেদের দিকেও এখন অন্যরা আঙ্গুল তুলবে।’ কমিটি একটি হওয়াই উচিত ছিল মন্তব্য করে সাঈদ বলেন, ‘কিছু ভুল আমাদের, কিছু ভুল তাদের। আমাদের সবারই উচিত আরো একটু সময় নেয়া।’
এ বিষয়ে কথা বলতে অপর কমিটির সভাপতি লাবলু আনসারের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই নির্বাচনের পক্ষে ছিলাম। গণতান্ত্রিক রীতির পক্ষে ছিলাম। কিন্তু শুরু থেকেই তারা নির্বাচন চায়নি। হাত তুলে নতুন কমিটি গঠন করতে চেয়েছে। আমি প্রশ্ন রাখবোÑ গোপন ব্যালটের মাধ্যমে তাদের নির্বাচনে আসতে বাধা কোথায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রথম কার্যকরী কমিটির সভায় নয়জনের মধ্যে আমরা পাঁচজন নির্বাচনের পক্ষে ছিলাম। কিন্তু তারা চারজন চেয়েছিল হাত তুলে নতুন কমিটি গঠন করবে। কিন্তু পরে বিশেষ সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত চূড়ান্তের বিষয়ে সবাই একমত হন। ওই সাধারণ সভায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এরমধ্যে আমাদের প্রস্তাবনায় দুজন এবং নাজমুল আহসান ও দর্পণ কবীরদের প্রস্তাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচিত হন। এখন সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা যদি নির্বাচনে যেতে রাজী না হন তাহলে কি করার থাকতে পারে।’
এই কমিটির কোষাধ্যক্ষ রিজু মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছি। নির্বাচন কমিশন নির্বাচিত করে নাম ঘোষণা করেছে। তাই বৈধ কমিটি হিসেবে আমরাই সংগঠনের নাম ও লোগো ব্যবহার করবো।’
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ১৩ মার্চ গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সদস্যদের সাধারণ সভায় কন্ঠভোটেই নতুন কমিটি গঠনের কাজটি সম্পন্ন হয়ে আসছে। এই ধারার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এবারই প্রথম একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় ও তাদের মাধ্যমে সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ বিরোধ তিক্ত হয়ে ওঠে এবং শেষ অব্দি এর দ্বিধাবিভক্তি চূড়ান্ত রূপ নেয়।
নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্বে দুই পক্ষের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধের সূত্রপাত মূলত নির্বাচনের তারিখ নিয়ে। ২৮ ডিসেম্বর ক্লাবের বার্ষিক সাধারণ সভায় তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের পর ১৬ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির সভায় ১৯ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ধার্য করা হয়। নির্বাচনের তারিখ ধার্য সম্পর্কিত নির্বাহী কমিটির এই সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন মেনে নিতে রাজী হয়নি। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণসহ নির্বাচন বিষয়ক সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের এমন বক্তব্য দিয়ে তারা একটি মত বিনিময় সভা আহ্বান করেন এবং সেখানে শুধু একটি পক্ষের উপস্থিতিতে ১৯ মার্চের পাল্টা ১১ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাহী কমিটির সভাপতি নাজমুল আহসান ও সাধারণ সম্পাদক দর্পণ কবীরের পক্ষের কাউকে এই সভায় ডাকা হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। নির্বাচন কমিশনের এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী কমিটি কমিশনের সদস্যদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে কমিশন বিলুপ্তি ঘোষণা করে। ওই সময় তারা অভিযোগ করেন, অপর পক্ষের দুজন সদস্য ওই সময় বাংলাদেশে অবস্থান করবেন তাই তারা ১৯ মার্চের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বিধায় নির্বাচন কমিশন কার্যকরী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কার্যকরী কমিটির এই সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে এবং তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় নাজমুল-দর্পণ বিরোধী গ্রুপ। তারা ১১ মার্চের নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের প্যানেল ঘোষণা করে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নির্বাহী কমিটি গত ২৬ ফেব্রুয়ারী ক্লাবের একটি জরুরি সাধারণ সভা আহবান করে। এই সভায় উপস্থিত সদস্যদের সম্মতিতে কন্ঠভোটে মোহাম্মদ সাঈদকে সভাপতি ও শওকত ওসমান রচিকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।
অপরদিকে, নির্বাচন কমিশনের তফশিল অনুযায়ী মনোনয়ন পত্র জমা দেয়া ও প্রত্যাহারের শেষ সময় পর্যন্ত লাবলু আনসার ও শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন একটি মাত্র প্যানেলের মনোনয়ন দাখিল হওয়ায় তাদেরকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য: এদিকে, বর্তমান কার্যকরী কমিটির দাবি অনুযায়ী অব্যাহতিপ্রাপ্ত এবং সংগঠন থেকে বহিস্কৃত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপরাপর সদস্যদের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের এক বিশেষ সাধারণ সভায় গত ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ সাধারণ সদস্যরা সর্বসম্মতভাবে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। নির্বাচন কমিশন ক্লাবের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনের সার্বজনীন নীতিমালা ও নির্বাচন সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ নিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করেছে।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়ন জমাদানকারীদের প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ পর্যন্ত। নির্ধারিত দিনে প্রার্থীতা প্রত্যাহার ও বাছাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে প্রতিটি পদে একজনের বেশী প্রার্থী পাওয়া যায়নি। অতএব কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় গৃহীত মনোনয়নত্র জমাদানকারীদের প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচিত ব্যক্তিরা হলেন: সভাপতি- লাবলু আনসার, সহ সভাপতি- মীর-ই ওয়াজিদ শিবলী, সাধারণ সম্পাদক- শহীদুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক- রিজু মোহাম্মদ, কোষাধ্যক্ষ- মোহাম্মদ আবুল কাশেম, কার্যকরী সদস্য- যথাক্রমে আশরাফুল হাসান বুলবুল, নিহার সিদ্দিকী, কানু দত্ত এবং মোহাম্মদ আজিম উদ্দিন অভি।
নির্বচনের তফশিল অনুযায়ী আগামী ১১ মার্চ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবার যে ঘোষণা ছিল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কমিটির সকল কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়ায় এখন আর ভোট গ্রহণ হবে না। তবে মেয়াদ বর্ধিত কার্যকরী কমিটির ক্ষমতা ৩১ মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। যদি এই সময়ের মধ্যে বর্তমান কমিটি নবনির্বাচিত কমিটিকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান তা করতে পারবেন। বর্তমান কার্যকরী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনুষ্ঠিতব্য আগামী ১৯ মার্চের বাৎসরিক সাধারণ সভায়ও তা করতে পারেন।
আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব গঠনের ইতিহাসে প্রথমবারের মত নির্বাচনটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অনুষ্ঠানে যাদের সহযোগিতা পরামর্শ পেয়েছি, বিশেষ করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকবৃন্দ ও ক্লাবের সাধারণ সদস্যদের প্রতি কৃজ্ঞতা প্রকাশ করছি। (সাপ্তাহিক আজকাল)